সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা- এই মন্ত্রে ফরাসি বিপ্লব দুনিয়ার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিলেও ফ্রান্সে সেই বিপ্লব হাইজ্যাক হয়ে গিয়েছিল ‘জুলাই রাজতন্ত্রে’। ১৭৮৯ সালে যে রাজতন্ত্রের কবর হয়েছিল, তা ভিন্ন চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল ১৮৩০ সালের ২৬ জুলাই, লুই ফিলিপের রাজা হয়ে ফেরার মাধ্যমে।
তবে সেই জুলাই রাজতন্ত্রও পড়েছিল প্রতিরোধের মুখে। ১৮৪৮ সালে হয়েছিল আবার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফের সাধারণতন্ত্রে ফিরেছিল ফ্রান্স, ইতিহাসে যাকে বলে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’।
তবে তা টিকেছিল মোটে পাঁচ বছর। ফ্রান্সের দ্বিতীয় সাধারণতন্ত্রে প্রেসিডেন্টের পদে বসা তৃতীয় নেপোলিয়ন কর্তৃত্ববাদী শাসন চালানোর এক পর্যায়ে নিজেকে আবার সম্রাট ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের লক্ষ্য হিসেবে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ গঠনের ঘোষণা দেওয়ার পর তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা।
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে তারা আসলে কী বোঝাতে চাইছেন, সেখানে যেমন অস্পষ্টতা রয়েছে। তেমনি বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলো এই উদ্দেশ্য নিয়ে তুলেছে প্রশ্ন।
গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের।
সেই অভ্যুত্থানকারীদের পরবর্তী নানা পদক্ষেপ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠার মধ্যেই শুক্রবার তারা রাজনৈতিক অভিলাষ বাস্তবায়নে জাতীয় সিটিজেন পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে যাত্রা শুরু করে।
নতুন দলের ঘোষণায় আছে কী
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানেই নাগরিক পার্টির রাজনৈতিক ঘোষণা উপস্থাপন করেন নতুন এই দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
মানিক মিয়া এভিনিউর সমাবেশে তিনি বলেন, “একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে।
“আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।”
জুলাই অভ্যুত্থানের শীর্ষনেতাদের একজন নাহিদ অভ্যুত্থানের পর উপদেষ্টার দায়িত্ব নিলেও পদত্যাগ করে এখন নতুন দলের দািয়ত্ব নিয়েছেন।
নাহিদরা শুরু থেকেই বাহাত্তরের সংবিধান বদলে দেওয়ার পক্ষপাতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ও নতুন দলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ গত ২৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের’ মাধ্যমে বাহাত্তরের ‘মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে’।
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই সনদ তৈরির দায়িত্ব নেয়, তখন অভ্যুত্থানকারীরা পিছু হটে।
সেই জুলাই সনদের বিষয়ে অগ্রগতির কোনো খবর না থাকার মধ্যে নতুন দল গঠন করে অভ্যুত্থানকারীরা তরুণরা এখন সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা সামনে আনল।
অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২২ অক্টোবর ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণা প্রথম আলোচনায় এনেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে ঘোষিত ৫ দফায়।
এরপর ওই ৫ দফা নিয়ে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করলেও ইতিবাচক সাড়া পায়নি। এরপর ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কথাটি চাপা পড়েই ছিল।
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে আসলে কী বোঝানো চাইছেন- প্রথম আলোর সেই প্রশ্নে জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “প্রথম রিপাবলিক হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের পর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেই সংবিধানে কিছু কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে।
“এই কাঠামো বারবার সংশোধন করা হয়েছে। গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদ রীতিমতো গেঁড়ে বসেছিল। এই ফ্যাসিবাদকে সরাতে দুই হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন। সেই জায়গা থেকে সংবিধানের কাঠামোটা এমনভাবে তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে কোনো দল ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে।”
তার ভাষ্যে, “রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নাগরিকরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের রক্ষক হয়। এই পরিবর্তনগুলো করতে হলে সংবিধানে খুব র্যাডিকেল পরিবর্তন প্রয়োজন। এটিকেই আমরা সেকেন্ড রিপাবলিক বলছি।”
সেই সেকেন্ড রিপাবলিক আনতে হলে তা বর্তমান সংবিধান সংস্কার করে সম্ভবপর নয় বলে মনে করেন তিনি।
আদিব বলেন, “আমরা সংবিধান বাতিল চেয়েছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। এখন তো সংবিধানের মূল ভিত্তি রেখে সংশোধন হয়। কিন্তু সেকেন্ড রিপাবলিক হলে রিপাবলিকটাই হবে মূল ভিত্তি।
“সেটার ওপর ভিত্তি করে সংবিধান পুনর্লিখনও হতে পারে অথবা কাটাছেঁড়াও হতে পারে।”
বিশ্লেষকরা দেখছেন অস্পষ্টতা
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ নিয়ে নতুন দলের বক্তব্য স্পষ্ট হচ্ছে না বিশ্লেষকদের কাছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ বদরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, “ফ্রান্সসহ যেসব সমাজে এ ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, সেই পরিবর্তনগুলো হয়েছে কোনো না কোনো নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশেও একটা পরিবর্তন ঘটেছে।
“জাতীয় নাগরিক পার্টি যে সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলছে, তাদের নিশ্চয়ই একটা দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তা আছে। সময়ই বলে দেবে এ ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যটা আসলে কী বা সেটা দেশের জন্য কী বয়ে আনবে?”
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলেছে। বিএনপি আবার তরুণদের নতুন দল নিয়ে নানা প্রশ্নও তুলছে।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে চাপে রাখতেই সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলা হচ্ছে কি না, সেই ধারণাও করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। কারণ এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, শাসন ক্ষমতায় দলের পরিবর্তনই অভ্যুত্থানের মূল কথা নয়।
তবে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও বিএনপিসহ সব দলের মতৈক্য ছাড়া তা অসম্ভব বলে মনে করেন রাজনৈতিক গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বিবিবি বাংলাকে বলেন, “গণপরিষদ মানে হলো নতুন সংবিধান করা হবে। অর্থাৎ সামনে যে নির্বাচনে হবে তাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গণপরিষদ সদস্য হিসেবে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। ওই গণপরিষদই আবার পার্লামেন্ট হিসেবে কাজ করবে।
“কিন্তু এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য দরকার, সেটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি নিকট ভবিষ্যতে দেখি না।”
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটি সত্য যে বর্তমানের সংবিধান গণতন্ত্র চর্চার জন্য উপযোগী নয়। এ অবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার কথা বলা যায়।
“কিন্তু দেশে এখন যারা দ্রুত দ্রুত নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার যারা চায়, তাদের সাথে এ নিয়ে সংকট তৈরি হওয়ার আভাস আছে। এগুলো করতে হলে অন্য সব দলকে নিয়েই সেটা করতে হবে। সেখানে রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপার আছে।”
আবার নতুন দলের নেতারা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার চেয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলতেই বেশি সময় নিচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকদের চোখে ধরা পড়েছে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের বার্তা কিংবা অবস্থান পরিষ্কার। কিন্তু তারা নতুন কী করবে, সেটা বলতে পারেননি।
“দলটিতে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মতের সমাবেশ আছে। তাদের একটা জায়গায় এনে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করার বোঝা যাবে যে তারা আসলে কী বার্তা দিতে চাইছে।”
নতুন দল ‘নতুন বাংলাদেশ’ বলতেও নতুন কী কী ব্যবস্থা করতে চায় এবং অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম বিষয়েও কী অবস্থান, তা এখনও অস্পষ্ট বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “তারা আওয়ামী লীগবিরোধী সব দলকে ডেকেছে। দেখে মনে হয় একটা সমন্বয়ের রাজনীতির বার্তা আছে। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ গণতন্ত্র, কেউ সমাজতন্ত্র, আবার কেউ কেউ খিলাফত চায়। এসব বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট দেখছি না।”
বিএনপির প্রশ্ন-সন্দেহ
নানা প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে অভ্যুত্থানকারী তরুণদের মতভেদ দিন দিন বাড়ছে। সেকেন্ড রিপাবলিক প্রশ্নেও তারই ছাপ দেখা যাচ্ছে।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশের পরদিন শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ঢাকায় এক আলোচনা সভায় প্রশ্ন তুলেছেন, সেকেন্ড রিপাবলিক কখন হয়? গণপরিষদ কেন হবে?
কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আলোচনা সভায় তার বক্তব্য বাংলাদেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই এসেছে।
সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন বলেন, “আমি নতুন বন্ধুদের বলতে চাই, সেকেন্ড রিপাবলিক…আমাদের বর্তমান রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে?
“সেকেন্ড রিপাবলিক কখন হয়? রিপাবলিক হচ্ছে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, তাদের একটা নমিন্যাল অথবা ইলেকটেড হেড দ্য স্টেট থাকবে। সেটা কি আমাদের নেই?”
গণপরিষদ কেন হবে? এ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “যারা গণপরিষদের বিষয় সামনে আনছে, যারা সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয় সামনে আনছে, হয় তারা বোঝে না অথবা বুঝেও আমাদের এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘায়িত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র আছে।”
সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির আপত্তি নেই জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, “সেই সংবিধানের নাম যদি আপনারা নতুন সংবিধান দেন, ঠিক আছে। কিন্তু গণপরিষদ কেন বললেন, আমরা বুঝলাম না।
“যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান রচিত থাকে না, মানে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। আমাদের এখানে গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য আমরা কি নতুনভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি? রাষ্ট্র তো স্বাধীন আছে। আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের যেভাবেই হোক, একটা সংবিধান আছে।”
“যারা সেকেন্ড রিপাবলিকের ঘোষণাপত্র তাদের দলীয় ঘোষণাপত্রে রেখেছেন, সেটা ওখানে থাক। যারা গণপরিষদের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে চান, সেটা আপনারা যখন পারবেন, করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে আর যাতে কোনো বিলম্ব না হয়,” বলেন এই বিএনপি নেতা।