নিষেধাজ্ঞা অসাংবিধানিক, নির্বাচনে যাব: শেখ হাসিনা

বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: এনডিটিভি
বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: এনডিটিভি

বাংলাদেশে গত ক’দিন ধরে আলোচনায় দীর্ঘ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। একদিন আগেও তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ হয়েছে প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্য উইকে। এবার দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে দিলেন সাক্ষাৎকার, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যেন হয়ে দাঁড়াল ‘গরম তেলে পানির ছিটা’।

ব্যক্ত করেছেন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অভিপ্রায়, নিজের দলের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বৈধতা মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের রয়েছে কিনা তা নিয়েও তুলেছেন প্রশ্ন।

সব ছাপিয়ে জুলাই আন্দোলনে হতাহতের ঘটনা নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে দেখা গেল গৌতম লাহিড়ীর প্রশ্নের জবাবে।

ইমেইলে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, সরকারপ্রধান হিসেবে সেসময়ে নেতৃত্বের দায় তার ওপর বর্তায়। তবে প্রাণহানির ঘটনা এড়ানোই ছিল তার উদ্দেশ্য।

তিনি বলেন, “দেশের নেতা হিসেবে শেষ পর্যন্ত নেতৃত্বের দায় আমার। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো নিতে যে আমিই নিরাপত্তা বাহিনীকে সরাসরি আদেশ বা নির্দেশ দিয়েছি এমন ধারণা ভুল। সৎ মনোভাব নিয়েই সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রাণহানি কমানো ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি প্রতিহত করা।”

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে বিক্ষোভসংশ্লিষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৪০০ জনের কথা বলা হয়েছে।

প্রাণহানি নিয়ে জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনের ওপর এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অপপ্রচার চালাতে জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে প্রভাবিত করেছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তাদের কাছে নির্ভুল মৃত্যু সংখ্যা নির্ধারণের জন্য ১৫ মাসেরও বেশি সময় ছিল, তবুও তারা এখনো একটি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি এবং ঘটনাটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।”

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান অধিদপ্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ৮৩৬। খোদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন এই সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও ১ হাজার ৪০০ জন হবে না বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে জানিয়েছেন।

ইমেইলে নেওয়া শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটি শুক্রবার প্রকাশ করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

শেখ হাসিনা অবশ্য দাবি করেছেন, হতাহতের সংখ্যায় আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত।   

অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার পর দিল্লি তাকে অতিথি হিসেবেই রাখছে। তার মধ্যে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কিছু সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নিচ্ছিলেন। তাতেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বেশ বিরক্ত হয়েছিল।

গেল সপ্তাহে একযোগে বার্তা সংস্থা এএফপি, রয়টার্স ও ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে পৃথক সাক্ষাৎকার প্রচারের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মানদণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তুলতে দেখা গেছে মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস উইংকে।

আওয়ামী লীগে নিষেধাজ্ঞা অবৈধ

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাসিত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, তার দল ‘আন্তরিকভাবে চায়’ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে। তবে তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।

“এই পদক্ষেপ গভীরভাবে অগণতান্ত্রিক এবং বাংলাদেশের সংবিধানের লঙ্ঘন। কোন দলকে রাজনীতি করতে না দেওয়া গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যার মাধ্যমে দেশটি পুনরায় সম্প্রীতির সাথে স্বাভাবিক পথে এগিয়ে যেতে পারে।”

“আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে এমন নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়,” যোগ করেন বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন দলটির প্রধান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাসনে কাটানো এক বছরেরও বেশি সময় পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একের পর এক সাক্ষাৎকার প্রচারের মাধ্যমে তাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে তোলা হচ্ছে। এমন পর্যবেক্ষণের মধ্যেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নতুন করে সামনে নিয়ে এলো শেখ হাসিনাকে।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কভার প্রচ্ছদ করেছে প্রভাবশালী দ্য উইক ম্যাগাজিন।

তার দলের সদস্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা সেরকম ধারণা উড়িয়ে দেন।

তিনি বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞা আসলে আওয়ামী লীগের কোটি সমর্থক ও ভোটারের অধিকারকে ‘হরণ’ করেছে। বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা সহজে অন্য দলে ভোট দেন না।”

বাংলাদেশের ভোটারদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে এই অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ বলেন, “অতীতে যখন কোনো নির্বাচনে কোনো দল অংশ নেয়নি, তখনও দেখা গেছে ভোটাররা ভোট দিতে আসেননি, অন্য দলকেও ভোট দেননি।”

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, ‘বর্জন ও নিষেধাজ্ঞার’ এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সরকারের বৈধতাকে দুর্বল করে তুলেছে এবং এখন এটি ভাঙা অত্যাবশ্যক।

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, যারা সংবিধান রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং যাদের প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের সমর্থন আছে।”

জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের সুপারিশের কথা উল্লেক করে শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনে জাতিসংঘ স্পষ্ট সুপারিশ করেছে এবং আমি নিশ্চিত, যুক্তরাষ্ট্রও এমন কিছুই আশা করে।”

নির্বাচনী ব্যবস্থা ও আ. লীগ আমল

নিজের আমলে নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ প্রত্যাখ্যানও করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছে।”

বঙ্গবন্ধু কন্যা জোর দিয়ে দাবি করেন যে তার দল “কখনোই অসাংবিধানকি উপায়ে ক্ষমতা দখল করেনি।”

তাদেরর সরকার দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স এবং আইনগতভাবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন—এসবই আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব।

“কারো সন্দেহ নেই যে ১৯৭০-এর দশক থেকে ২০০১ পর্যন্ত নির্দিষ্ট নির্বাচনী প্রহসনের পর থেকে ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে।”

তবে, তিনি স্বীকার করেছেন যে তার নেতৃত্বে সব নির্বাচন ‘সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক’ ছিল না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কিছু দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বয়কট করেছিল।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এএফপির প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট।

শেখ হাসিনা বলেন, “সময় যত গিয়েছে, এটি আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। এখন অবশ্যই এই বর্জন চক্র ভাঙতে হবে।”

অর্থপাচারের অভিযোগ হাস্যকর

সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে জোরালো অংশে হাসিনা ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার অর্থপাচারের অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।

সম্প্রতি ফাইন্যানশিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই অভিযোগ তুলেছিলেন।

ইউনূসের অভিযোগকে ‘হাস্যকর এবং ভিত্তিহীন’ আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, “এই অর্থ বাংলাদেশ সরকারের মোট বাজেটের চেয়েও অনেক বেশি। বাস্তবে, এত বিশাল অর্থপাচার করা সম্ভবই নয়। যদি তা হত, আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যেত।”

তিনি বলেন, “বরং এর বিপরীত ঘটনাই ঘটেছে। তার মেয়াদকালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘৪৫০ শতাংশের বেশি’ বৃদ্ধি পেয়েছে—যা একটি রেকর্ড।”

এরপক্ষে প্রমাণ তুলে ধরে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটি কোন মনগড়া সাফল্যের গল্প নয়। আইএমএফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দ্বারা স্বীকৃত।”

ছেলে সাজীব ওয়াজেদ জয় এবং কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলকে বেআইনিভাবে সরকারি ভূমি বরাদ্দ দেওয়া বা ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি স্বীকার করছি, বাংলাদেশে দুর্নীতি বিদ্যমান। কিন্তু কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে আমার পরিবার বা সহযোগীরা ব্যক্তিগতভাবে কোনো সুবিধা নিয়েছে বা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিতে জড়িত ছিল।”

ইউনুসের ’অবৈধ সম্পদ’

এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেন তিনি। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ইউনূস বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করেছেন—যার মধ্যে প্রায় ৪,০৮০ কাঠা পূর্বাচলে, যেখানে তিনি ‘নিসর্গ’ নামে একটি রিসোর্ট নির্মান করেছেন। উত্তরায় আছে আরও ৩০০ কাঠা। বিভিন্ন ব্যাংকে ইউনূসের প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

“ড. ইউনূস ১৯৯০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে মাত্র ছয় হাজার টাকার বেতনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তাহলে তিনি কীভাবে এত বিশাল সম্পদ অর্জন করলেন?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “মিডিয়াকে এসব  সরলভাবে ভাবলে চলবে না, বরং এসব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করতে হবে, কেবলমাত্র ক্লিনটনের মতো সুপরিচিত বন্ধু থাকার কারণে ইউনূসকে ছাড় দেওয়া উচিত নয়।”

‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ বিষয়ে নীরবতা

ক্ষমতাচ্যুতিতে কোনো ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ ছিল কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, “এই মুহূর্তে আমি চুপ থাকাকে ভালো মনে করছি।”

তিনি এমন এক সময়ে নীরবতার পথ বেছে নিলেন যখন আঞ্চলিক ও পশ্চিমা মিডিয়ায় তার ক্ষমতাচ্যুতির পেছনে আন্তর্জাতিক প্রভাবের সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে, যদিও এ সম্পর্কিত কোনো সুর্নির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি।

সাক্ষাৎকারের শেষভাগে বাংলাদেশের দীর্ঘ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্ব সামলানো ৭৬ বয়সী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জাতিগত বিভাজন হ্রাস এবং গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের বিষয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের খুব প্রয়োজন স্বাভাবিক হওয়া এবং সবাই মিলে একসাথে আগানো। এটি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে সম্ভব নয়।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন