ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাত মাসে আগে সেনাবাহিনীর বিমানে চড়ে ভারতে চলে যাওয়া তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এই মার্চে দেশে ফিরছেন? এমন আলোচনা দেশজুড়ে। চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে সোশাল মিডিয়ায়- সর্বত্র এই আলোচনা এখন উতুঙ্গে।
এক পক্ষ বলছেন, সোশাল মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে দলের নেতাকর্মীরা।
আরেক পক্ষ বলছেন, ৫ আগস্টের আগে কেউ ভাবেনি শেখ হাসিনা ভারতে চলে যেতে পারেন; তেমনই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে এই মার্চ মাসে শেখ হাসিনার ফেরার মাধ্যমে।
ভারত সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে ‘বোমা ফাটানোর’ পর সর্বত্র আলোচনা শুরু হয়েছে ‘ইউনূস সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে’।
সোমবার এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি, জঙ্গিবাদের উত্থান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষকরে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যদের ওপর দুর্ভাগ্যজনক নিপীড়ন, নির্যাতন এবং হত্যার মতো ঘটনাগুলো মার্কিন সরকার এবং রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের জন্য অন্যতম প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’কে পরাস্থ করতে ট্রাম্প প্রশাসনের গভীর দৃষ্টি রয়েছে এবং তাদের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ‘উগ্র ইসলামী সন্ত্রাসবাদের’ উত্থান রোধ এবং সমূলে উৎপাটনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেও জানান তিনি।
বর্তমান ইউনূস সরকারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক মনোভাব জানার পর শেখ হাসিনার ফেরার খবরে আরো হাওয়া লেগেছে।
গত ১২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের এক নেতার বক্তব্য হৈ চৈ পড়ে যায় বাংলাদেশে।
ভারতের সংবাদ সংস্থা এএনআই-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডক্টর রাব্বি আলম এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও বাংলাদেশে ফিরবেন শেখ হাসিনা।”
ডক্টর রাব্বি আলমের মতে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য তরুণ প্রজন্মকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, “তরুণ প্রজন্ম একটি ভুল করেছে, কিন্তু এটি তাদের দোষ নয়, তাদের কারসাজি করা হয়েছে।”
ডক্টর রাব্বি আলম বলেন, “বাংলাদেশ এখন আক্রমণের মধ্যে রয়েছে, এবং এই সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপে সমাধান হওয়া দরকার। একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের অংশ হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা নয়। এটি একটি সন্ত্রাসী বিদ্রোহ।”
তিনি বাংলাদেশের বর্তমান উপদেষ্টাদের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে বলেন, “তাদের ফিরে যেতে হবে, যেখান থেকে তারা এসেছে।”
এর আগে গত ১০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল দাবি করেছিলেন মার্চের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পারবেন।
ভিডিও বার্তায় নাদেল বলেছিলেন, “জুলাই -আগস্টের প্রতিটি ঘটনাই ছিলো ইউনূসের ষড়যন্ত্রের অংশ। এ অবস্থা আর বেশি দিন চলতে দেয়া যায় না। মার্চের মধ্যে দেশের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পারবেন।”
বাংলাদেশ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ নেতাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ চাওয়া, ভারতের প্রতিক্রিয়া এবং মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান ইউনূস সরকারের বিষয়ে মনোভাব এক সুতোয় বাঁধছে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিজেদের চাঙ্গা করছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা। তারা ধারণা করছেন যেকোনো মুহূর্তে ডাক আসতে পারে। ঘোষণা পাওয়া মাত্র যাতে রাজপথে নামা যায় সেজন্য প্রস্তুতি শুরু করেছেন তারা।
রাজশাহী, নাটোর, রংপুর, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর, মাদারীপুর, পিরোজপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
সাবেক সংসদ সদস্য এবং জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাধারাণ সম্পাদক ছাড়া বেশিরভাগ নেতা বাড়িতে থাকছেন, নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও কাজ করছেন। কেউ আদালতে গিয়ে আইনজীবীর পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তবে সন্ধ্যার পর অনেকে বাড়ির বাইরে বের হন না।
১২টি জেলায় অন্তত ১৮ জন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে দ্য সান ২৪। এদের মধ্যে যেমন আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তেমন ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রয়েছেন। কথা হয় জেলা আওয়ামী লীগের সদস্যর সাথে। তবে সবাই এখনই নাম পদবী প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
রাজশাহী বিভাগের একটি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এক সময়ের প্রতিমন্ত্রী জানান, পাঁচ মাস আত্মগোপনে থাকার পর জানুয়ারি মাসে নিজ বাড়িতে এসেছেন। তবে খুব বেশি বাড়ি থেকে বের হন না। তবে ঘনিষ্ট আওয়ামী লীগের কর্মীরা তার বাড়িতে গিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
তিনি দ্য সান ২৪কে বলেন, “একটি দুঃসময়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। মানুষ আমাদের ভুল বুঝেছিল। কিন্তু সাত মাসে সবাই বুঝতে পেরেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা সঠিক ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন অনেকে বেড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “সোশাল মিডিয়ায় খবর দেখে তৃণমূলের অনেক কর্মী আমার ফোন দিয়ে জানতে চান শেখ হাসিনা কি সত্যি ফিরছেন? কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের সাবধানে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছি। আমাদের বিশ্বাস নেত্রী দ্রুত দেশে ফিরবেন।”
রংপুর বিভাগে একটি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক যিনি আইন পেশার জড়িত, দ্য সান ২৪কে বলেন, “নভেম্বর থেকে আমি প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছি। নিয়মিত আইনজীবী পেশা চর্চা করছি।”
এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “এর অন্যতম কারণ এখানে জামায়াতের প্রভাব কম। বিএনপির নেতারা প্রকাশ্যে প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে না বলে মনে হয়েছে। তাই আমার মতো আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।”
তিনি বলেন, “আমারা প্রকাশ্যে রাজনীতি করছি না। তবে ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংগঠিত হচ্ছি। যাতে ডাক পেলেই রাজপথে নামতে পারি।”
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এমাসে বাংলাদেশে ফিরবেন বলে বিশ্বাস করেন বেশির ভাগ নেতাকর্মী।
তারা বলছেন, ৫ আগস্টের আগে যেমন কেউ ভাবতেই পারেনি সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চেলে যাবেন। তখনও আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছিল- সবকিছু ঠিক আছে, সমস্যার সমাধান হচ্ছে। তবে ৫ আগস্ট দুপুরে দেশের মানুষ জানলেন শেখ হাসিনা ভারতে চলে গেছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তো বটেই দেশের মানুষও প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি।
৫ আগস্টের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবার ঘটবে বলে আশাবাদী আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী।
তাদের অভিমত, তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের মতো বর্তমানেও ইউনূস সরকারের লোকজন বলছে- সব কিছু ঠিক আছে, আওয়ামী লীগ পাগলের প্রলাপ বলছে। এবার ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবেন মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ফিরবেন শেখ হাসিনা।
সত্যিই কি মার্চে দেশে ফিরবেন শেখ হাসিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার বলেন, “দেশের মানুষ বলছে আগে শেখ হাসিনার সময়ে ভালো ছিলেন। এখন জঙ্গিরাষ্ট্রে দেশের মানুষ ভালো নেই। দেশ গঠনে শেখ হাসিনা অবশ্যই ফিরবেন। দেশে এসে নতুন প্রেক্ষাপটে রাজনীতি শুরু করবেন।”
কবে ফিরবেন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি দিনক্ষণ বলতে চাই না। তবে দ্রুত শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবেন। শেখ হাসিনা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে দলের নেতাকর্মীরাও দেশে ফিরবেন।”
ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার বলেন, “মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর আগুনে ঘি ঢালার মতো হবে। এই সফরের মাধ্যমে ইউনূসের বিদায় হতে পারে। চীন সফরে গিয়ে বাংলাদেশে তিনি নাও ফিরতে পারেন।”
শেখ হাসিনার ফেরার ‘উড়োখবর’ নিয়ে দৃশ্যত ‘বিচলিত’ সদ্য গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি’র নেতারাও। দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর গত ১৪ মার্চ রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও সেই বার্তাই দেয়।
হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেন, “যে পথ দিয়ে আওয়ামী লীগ পালিয়েছে, ঠিক সে পথ দিয়েই আওয়ামী লীগকে ফেরানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।”
এর আগে ১৩ মার্চ প্রায় একইরকম দাবি করে ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি।
ওই পোস্টে হাসনাত লিখেছিলেন, “এ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগকে ফেরানোর পরিকল্পনা চলছে। ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি ‘টেবলেট’ নিয়ে শীঘ্রই হাজির হবে। যারা এই পরিকল্পনা করছেন, আমি আপনাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি, এখানে কোনো ‘ইফস’ এবং ‘বাটস’ নেই।
তিনি লিখেন, “বিচারের পূর্বে আওয়ামী লীগের যেকোনো ধরনের পুনর্বাসনের চেষ্টার আলাপ দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে। সুতরাং ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগের টেবলেট নিয়ে হাজির হবেন না। আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত হওয়ার পূর্বে আর কোনো আলাপ নয়। ফুলস্টপ।”