জাকসুতেও শিবির, ছাত্রদল গেল ৪ নম্বরে

জাকসুতে বিজয়ীদের মধ্যে ভিপি পদে জয়ী আব্দুর রশীদ জিতু (মাঝে) ছাড়া বাকি সব শিবিরের।
জাকসুতে বিজয়ীদের মধ্যে ভিপি পদে জয়ী আব্দুর রশীদ জিতু (মাঝে) ছাড়া বাকি সব শিবিরের।

প্রার্থী, ভোটার এমনকি দেশবাসীরও ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে ৪৮ ঘণ্টা পর জাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষিত হলো। ডাকসু নির্বাচনের চিত্র দেখে জাকসুতেও ফল যে একই আসবে, সেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল। তবে সামান্য একটু ব্যতিক্রম ঘটেছে। ভিপি পদটি ছুটে গেছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের। সেই সঙ্গে দেখা গেল ছাত্রলীগবিহীন এই নির্বাচনেও ছাত্রদল নেমে গেছে চতুর্থ স্থানে।

ডাকসু নির্বাচনের দুদিন পর গত বৃহস্পতিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। তবে জাকসুর ভোটগ্রহণ শুরুর পরপরই অব্যবস্থাপনার চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে।

প্রস্তুতি সারা না যাওয়ায় বিভিন্ন হলে ভোটগ্রহণ শুরু করতেই দেরি হয়। তারপর বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটরের জন্য অপেক্ষার প্রহরও ছিল।

ভোট দেওয়ার পর যে কালি ভোটারদের আঙুলে দেওয়া হয়, দেখা গেল তা উঠে জাল ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ প্রস্তুত। ছবিসহ ভোটার তালিকা না হওয়ায় না নিয়েও শিক্ষার্থীরা তোলেন আপত্তি। এরপর দেখা গেল ব্যালটে কোনো কোনো প্রার্থীর নামই নেই। তখন হাতে নাম লিখে দিতে বলা হলো ভোটারদের।

এই অবস্থা চলতে থাকায় ভোট শেষের আগেই বর্জনের ডাক দেয় ছাত্রদলসহ সাতটি প্যানেল। শুধু ইসলামী ছাত্রশিবিরের এবং জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের গড়া সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) ভোট বর্জন করেনি।

ব্যালট গণনা ডাকসুর মতো মেশিনে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই মেশিন এক জামায়াত নেতার কোম্পানি থেকে আনার খবর ছড়ালে ওঠে আপত্তি। ফলে শুরু হয় হাতে গণনা।

ম্যারাথন সেই গণনার মধ্যে জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা নামে চারুকলা বিভাগের এক শিক্ষক মারা গেলেন অসুস্থ হয়ে। ব্যালট মেশিনে গুনলে তাকে হারাতে হত না বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মনে করেন।

বৃহস্পতিবার রাত গড়িয়ে গড়িয়ে শুক্রবার দিনও যখন গড়াল, কিন্তু ফল ঘোষণা করা গেল না, তারপর অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করলেন জাকসুর নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার টিটু। এরপর তার পথ অনুসরণ করলেন নির্বাচন কমিশনের আরেক সদস্য অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা হাসান।

তারও পরে শনিবার দিন শেষে ফল ঘোষণা হলো। তাতে দেখা গেল, জাকসুর ৫টি পদের মধ্যে ২০টিতেই জয় পেয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল।

১৯টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ১৫টিতে জিতেছেন শিবিরের প্যানেলের প্রার্থীরা। বাকি চারটি পদের মধ্যে ভিপিসহ তিনটি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। বাগছাস প্রার্থী জয়ী হয়েছে একটি পদে।

চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ছাত্রশিবিরের দখলে থাকলেও ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর ছিল ব্যতিক্রম। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত প্রায় তিন দশক ধরে নিষিদ্ধ ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের ছাত্র সংগঠনটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালের পর জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামী (পরে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত) এক সভায় গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে ফিরেছিলেন। সব ছাত্র সংগঠনগুলো তাকে প্রতিরোধ করেছিল।

জাহাঙ্গীরনগরে ১৯৯৪ সালে ছাত্রদল নেতা হাবিবুর রহমান কবির শিবিরকর্মীদের হামলায় নিহত হওয়ার পর সব ছাত্র সংগঠন মিলে ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, জাকসুতে তা পাসও হয়েছিল। এরপর ২০০৩ সালে নিজামী মন্ত্রী হয়ে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ধাওয়া খেয়ে ফিরে আসেন।

ফলে এই দুটি ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য কোনো তৎপরতা ছিল না। গোপনে লুকিয়ে তাদের কাজ চলত, এমনটি ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরে কারা কারা আছেন, তাদের নাম সংগঠনেরও সবাই জানত না।

গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে জামায়াতের দাপট নিয়ে ফেরার সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিবিরও ফিরেছে দাপটে। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা বিনা চ্যালেঞ্জে চলছে এগিয়ে।

বিএনপি-জামায়াত জোট হলেও এই দুটি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলও কখনো ছাত্রশিবিরকে মেনে নেয়নি। এখন জোট ভাঙার পর ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের পাল্লা চলছে। কিন্তু এক সময় ডাকসু ও জাকসুতে ছাত্রদলের জয়জয়কার থাকলেও চিত্র এখন গেছে পাল্টে।

ডাকসুতে শিবিরকে ঠেকাতে না পারলেও ভোটের হিসাবে গড়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ছাত্রদল। তবে কোনো পদে জিততে পারেনি। কিন্তু জাকসুতে দ্বিতীয় স্থানেও নেই ছাত্রদল। কোনো আসনে জিততে না পারার মিলটি অবশ্য রয়েছে।

জাকসুতে মোট ভোটার ছিল ১১ হাজারের মতো। ভোটের হার ছিল ৬৮ শতাংশের মতো, যার অর্থ ৮ হাজারের মতো শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছে।

জাকসুর ফলাফলে দেখা যায়, শিবিরে সব প্রার্থী গড়ে ৩ হাজারের মতো ভোট পেয়েছে। ছাত্রদলের প্রার্থীদের গড় ভোট ১ হাজারের মতো। ডাকসুর মতোই ছাত্রীদের হলে শিবির বেশ ভালো ভোট পেয়েছে। তাদের ছয়জন নারী প্রার্থীর সবাই জিতেছেন।

তবে ভিপি পদে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশীদ জিতু, যিনি গেল বছরের জুলাইয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের আগে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবশ্য পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। তাকে বাগছাস ভিপি প্রার্থী না করায় তিনি নিজেই আলাদা একটি প্যানেল দেন। তার প্যানেলের সদস্যরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে শিবিরের সঙ্গে।

জিতু পেয়েছেন ৩৩৩৪ ভোট, তার পেছনে থাকা শিবিরের ভিপি প্রার্থী আরিফ উল্লাহ আদিব পান ২৩৯২ ভোট। ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মো. শেখ সাদী হাসান পেয়েছেন ৬৪৮ ভোট। বাগছাসের ভিপি প্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বলও (১২১১) ছাত্রদলের সাদীর চেয়ে বেশি ভোট পান।

জিএস পদে শিবিরের মাজহারুল ইসলাম জয়ী হয়েছেন ৩ হাজার ৯৩০ ভোট পেয়ে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাগছাসের প্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম পেয়েছেন ১২৩৮ ভোট। জিএস পদে ছাত্রদলের তানজিলা হোসেন বৈশাখী পেয়েছেন ৯৪১ ভোট। জিতুর প্যানেলের জিএস প্রার্থী শাকিল আলীও (৯৫৯) ছাত্রদলের বৈশাখীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে ছাত্রশিবিরের প্রার্থী ফেরদৌস আল হাসান ২৩৫৮ ভোট জয়ী হয়েছেন। এই পদে বাগছাসের জিয়া উদ্দিন আয়ান পেয়েছেন ২০১৪ ভোট। এই পদে জিতুর প্যানেলের তৌহিদুল ইসলাম নিবির ভূঁঞার (৭১৫) চেয়েও কম ভোট পেয়েছেন ছাত্রদলের সাজ্জাদ উল ইসলাম (৭০১)।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে বিজয়ী ছাত্রশিবিরের আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা ৩৪০২ ভোট পেয়েছেন। ছাত্রদলের আঞ্জুমান আরা ইকরা পেয়েছেন ৭৬৪ ভোট। তার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন বাগছাসের মালিহা নামলাহ (১৮৩৬)।

অন্য সব পদে শিবির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, সেখানেও তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয় বাগছাস প্রার্থী, নয়ত স্বতন্ত্র প্রার্থী। নাট্য সম্পাদক পদে শিবিরের রুহুল ইসলাম হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জিতেছেন। তার চেয়ে এক ভোট কম পেয়ে হেরেছেন বাম প্যানেলের প্রার্থী ইগিমি চাকমা।

এছাড়া বাম সংগঠনগুলোর কোনো প্রার্থী ভোটের টালিতে সংখ্যা বড় করতে পারেননি, যদিও এই ক্যাম্পাসে এক সময় তাদের শক্ত অবস্থান ছিল।

অবস্থার বদলে এখন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র সংসদ করায়ত্ত করল শিবির, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি হিসেবে যারা এক সময় ক্যাম্পাস দুটোতে কাজই করতে পারত না।  

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন