ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১০, ‘অশনি সংকেত’ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

রিখটার স্কেলের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বহু ভবনে ফাটল ধরেছে, পলেস্তারা খসে পড়েছে বহু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের। ফাইল ছবি।
রিখটার স্কেলের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বহু ভবনে ফাটল ধরেছে, পলেস্তারা খসে পড়েছে বহু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের। ফাইল ছবি।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১০ জন হয়েছে, আহত হয়েছেন আনুমানিক পাঁচশ। রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার এই কম্পনের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার পাশে নরসিংদীর মাধবদীতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে শুক্রবার ছুটির দিনের এই আঘাত একটি ‘অশনি সংকেত’।

তবে ভূমিকম্পের মাত্রা অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা কিছুটা বেশি হয়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তার মতে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কাছাকাছি হওয়ায় এমনটা হয়ে থাকতে পারে।

বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, সকাল ১০টা বেজে ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে পাঁচ দশমিক সাত মাত্রা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। ২৬ সেকেন্ড স্থায়ী এ ভূমিকম্পে প্রাথমিকভাবে আতঙ্ক ছড়ায়, বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। এরপর আসতে শুরু করে প্রাণহানি আর ক্ষয়ক্ষতির খবর।

নিহতদের মধ্যে ঢাকার বংশালের কসাইটুলিতে ৩ জন, একজন মুগদায় এবং একজন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মারা যান। এছাড়া নরসিংদীতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ জন হয়েছে।

বংশাল থানার এএসআই জাকারিয়া হোসেন জানিয়েছে, ভূমিকম্পের সময় আরমানিটোলার কসাইটুলি এলাকার একটি আটতলা তলা ভবনের পাশের দেয়াল এবং কার্নিশ থেকে ইট ও পলেস্তরা নিচে খসে পড়ে। এসময় ভবনের নিচে থাকা একটি গরুর মাংসের দোকানে থাকা ক্রেতা ও পথচারীরা আহত হন।

এ পর্যন্ত ছয় জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে, আহত হয়েছেন শতাধিক। ছবি: ঢাকা ট্রিবিউন

ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন তাদের মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

তারা হলেন, রাফিউল ইসলাম, হাজি আবদুর রহিম ও তার ছেলে মেহরাব হোসেন রিমন। মুগদায় প্রাণ হারিয়েছেন নিরাপত্তাকর্মী মাকসুদুর রহমান।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভূমিকম্প শুরু হলে ১০ মাস বয়সী ফাতেমাকে কোলে নিয়ে তার মা বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাদের ওপর দেয়াল ধসে পড়ে। এতে শিশু ফাতেমা ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং তার মা আহত হন।

এছাড়াও খিলগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পাশের দোতলা একটি বাসায় একটি ইট পড়ে একজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

নরসিংদীর পলাশ থানায় মালিতা গ্রামে মাটির ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে কাজেম আলী ভূইয়া (৭৫) নামের একজনের মৃত্যুর তথ্য সমকালকে সকালে নিশ্চিত করেছিলেন পলাশ থানার ওসি মনির হোসেন।

পরে এ সংখ্যা বেড়ে পাঁচ জন হয়েছে। তারা হলেন, চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলি এলাকার দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বাল (৪০) ও তার ছেলে মো. ওমর (৮), কাজীরচর নয়াপাড়া গ্রামের নাসির উদ্দিন (৬৫) এবং শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের আজকীতলা গ্রামের ফোরকান মিয়া (৪৫)।  

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল মাধবদী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় আনুমানিক পাঁচশ জন আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন খবর পাওয়া গেছে।

‘এটি অশনি সংকেত’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প গবেষক মেহেদি আহমেদ আনসারীর মতে, “বড় ভূমিকম্প আসার আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, এটি তার আগাম বার্তা।”

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন, সাধারণত একশ থেকে দেড়শ বছর পরপর একটি অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ও এর আশপাশের কাছাকাছি এলাকায় গত দেড়শ বছরে একটি বড় ও প্রায় পাঁচটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে।

বাংলাদেশের আশপাশে সবশেষ বড় ভূমিকম্প সংগঠিত হয়েছিল প্রায় একশ বছর আগে। তাই আরেকটি বড় ভূমিকম্প কাছাকাছি সময়ে হতে পারে এমন শঙ্কা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন আনসারী।

তিনি বলছেন, “বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরি করলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে এটিই স্বাভাবিক। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”

বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে যে ভবনগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা বেড়েই চলেছে, বলেন তিনি।

আরেকটি বড় ভূমিকম্প কাছাকাছি সময়ে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রায় একইরকম ভাষ্য মিলেছে ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতারের কাছ থেকেও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, তিনি বলেন, “শক্তি লকড অবস্থায় ছিল, আটকে ছিল। এটা আনলকিং শুরু হয়েছে। এখন পরবর্তীকালে গ্যাপ দিয়ে আবার ভূমিকম্প হতে পারে।”

বাংলাদেশের উত্তরে আছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় বাংলাদেশ ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।

“সেক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হচ্ছে মহড়া। ভূমিকম্পের সময় দুয়েক কদমের মধ্যে নিরপদ জায়গায় চলে যাওয়া, প্রশিক্ষণ নেওয়া। দেশের যে অবকাঠামোম তা তো পরিবর্তন করা যাবে না। একমাত্র উপায় মহড়া,” যোগ করেন হুমায়ুন আখতার।

অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঢাকায় ঝুঁকির মাত্রা সবসময় বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকার এত কাছে গত কয়েক দশকে বড় ভূমিকম্প হয়নি। কয়েক জেনারেশন এরকম ভূমিকম্প দেখেনি।”

হুমায়ুন আখতার ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করেছেন কয়েক দশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত আর্থ অবজারভেটরির তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন।

বাংলাদেশ কেন ঝুঁকিতে

ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা—এ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে বড় বড় ফল্ট আছে।

আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা সমকালকে জানান, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। পুরো পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে।

ফারজানা আরও বলেন, সঞ্চিত শক্তি যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।

“বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, ভারত, নেপালের অবস্থান ওই তিন ফল্ট লাইনের আশেপাশে। তাই, মিয়ানমারের ৫ মাত্রার ভূমিকম্প আমরা অনুভব করি। আর যদি সেখানে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তখন আমাদের ওপর সেই প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর ভারত বা নেপালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ওই সম্ভাবনা আরও বেশি,” যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশ জাপানের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ না। আমরা মডারেটলি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। কিন্তু, সেই অনুযায়ী আমাদের তো প্রস্তুতি নাই। আমাদের বিল্ডিং কোড মানা হয় না। 

প্রতীকী ছবি।

এর আগে সিলেট, নোয়াখালী অঞ্চলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে। তবে এবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্র ঢাকার আরো কাছে, নরসিংদীতে।

মেহেদি আহমেদ আনসারীর বলছেন, “বাংলাদেশের মধ্যে টেকটোনিক প্লেটের যে পাঁচটি সোর্স আছে তার মধ্যে নোয়াখালী থেকে শুরু করে কক্সবাজার, নোয়াখালী থেকে সিলেট এবং আরেকটি সিলেট থেকে ভারতের দিকে চলে গেছে।”

নোয়াখালী থেকে সিলেট, এই অংশে যে বড় ফাটল রয়েছে তারই একটি ছোট অংশ নরসিংদী, এর ফলে নরসিংদী এলাকায় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হওয়া অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন তিনি।

দেশের ইতিহাসে বড় ভূমিকম্প

দেশে সাম্প্রতিক সময়ে হালকা ও মাঝারি মাত্রার বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হলেও সেগুলোর কোনোটিই মাত্রার দিক দিয়ে শক্তিশালী বা প্রলয়ঙ্করী ছিল না।

তবে গত তিনশ বছরে সেরকম কয়েকটি ভূমিকম্প ঘটেছে, সেগুলোর উৎপত্তিস্থল দেশের ভেতরে বা আশপাশের এলাকায় ছিল। এরমধ্যে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ফল্ট লাইনে ১৭৬২ সালে ৮.৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল।

ওই ভূমিকম্পেই সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রায় তিন মিটার ওপরে উঠে আসে; আগে সেটি ছিল ডুবন্ত দ্বীপ।

সেবার সীতাকুণ্ডে পাহাড়ে নিচ থেকে কাদা–বালুর উদগীরণ ঘটে, বঙ্গোপসাগরে বিশাল আকারের ঢেউ তৈরি হয়ে বহু ঘরবাড়ি ভেসে যায়, প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ বদলে দেয়।

এরপর ১৮৬৯ সালে সিলেটের কাছে জৈন্তা পাহাড়ের উত্তরাংশে অবস্থিত শিলচড়ে রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যা ‘কাচার আর্থকোয়াক’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল।

সেই ভূমিকম্পে শিলচড়, নওগাং ও ইম্ফল এলাকায় বহু স্থাপনা ধসে পড়লেও প্রাণহানির সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

ছুটির দিনের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনা সদস্যরাও যোগ দেন। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রারভূমিকম্প হয়েছিল মানিকগঞ্জে, ১৮৮৫ সালে। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় ছিল এর উৎপত্তিস্থল। ভারতের সিকিম, বিহার, মনিপুর ও মিয়ানমার পর্যন্ত এর কম্পন অনুভূত হয়। আঘাতে প্রাণহানি হয় ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, শেরপুর এবং পাবনায়।

এরপর ১৮৯৭ সালে মেঘালয়ের শিলং অঞ্চলে উৎপন্ন হওয়া ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে দেড় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, সিলেটেই প্রাণহানির সংখ্যা ছিল পাঁচ শতাধিক।

সিলেটের বহু বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়, ময়মনসিংহ এবং দেশের উত্তরাঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেবার বিভিন্ন এলাকায় ফাটল দেখা দেয় এবং সুরমা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথে এর প্রভাব পড়ে।

১৯১৮ সালের এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৬, উৎপত্তিস্থল ছিল শ্রীমঙ্গলের বালিছড়া। সেবার শ্রীমঙ্গল ও ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়, তবে প্রাণহানির সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

চট্টগ্রামে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ১৯৯৭ সালে, যাতে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল, তবে ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি। এর দুই বছরের ব্যবধানে ১৯৯৯ সালে মহেশখালীতে ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্পে অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছিল।

আরও পড়ুন