এবারের গন্তব্য তালিন, এস্তোনিয়ার রাজধানী। আগের রাতেই হেলসিংকি পৌঁছেছি প্রায় সাড়ে ছয়শ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রার পর। ড্রাইভিংয়ের ধকল আর সকালে জাহাজের শিডিউল ধরার উদ্বেগ নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া।
ঘুম ভাঙলো বৃষ্টিস্নাত সকালে, যেন আকাশও আমাদের যাত্রার ছন্দে মেতে উঠেছে। আমরা যাচ্ছি গাড়ি নিয়ে। সমুদ্রপথে। হেলসিংকি ফেরি টার্মিনাল হয়ে তালিন। সহযাত্রী মেয়ে আর তার মা।
জাহাজ ছাড়বে ১১টা ৩০ মিনিটে, তাই বৃষ্টি মাথায়ই টার্মিনালমুখী যাত্রা। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা বেজে ৫ মিনিট। উত্তরের শহর অউলুর সঙ্গে হেলসিংকির তফাতটা টের পেলাম রাস্তায় নেমে। গুগলের নির্দেশনা মেনে টার্মিনালে পৌঁছুনোর আগে অন্তত তিনবার ভুল পথে ঢুকে পড়েছি। ভাগ্য ভালো সময়মতো টার্মিনালে পৌঁছুতে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ফেরির জেটির দৃশ্য যেন আরেক যুদ্ধক্ষেত্র! সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে। পরিবার, পর্যটক, দৌঁড়াদৌড়ি- সবাই একসঙ্গে ছুটছে সমুদ্রের পানে।
এক এক করে গাড়ি সামনে এগোচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে আমাদের গাড়িও উঠে পড়লো জাহাজে। বিশাল সেই ফেরির ভেতর ঢুকে চোখ কপালে ওঠল- একেবারে এক ভাসমান শহর!

ভাইকিংলাইনের অ্যাপস নামানো ছিল, তাই জানা ছিল কোথায় কোন আয়োজন। লাইভ কনসার্ট, বাচ্চাদের জন্য সার্কাস পারফর্ম্যান্স, মজাদার ম্যাজিক শো। এক কথায় পয়সা উসুল।
এই পুরো অভিজ্ঞতা যেন শিশুদের জন্য ছোটখাটো ডিজনিল্যান্ড আর বড়দের জন্য এক শান্ত রেস্ট লাউঞ্জের সমাহার।
যেমনটা জানা ছিল, জাহাজ ছাড়লো ঠিক সময়ে। আমরা উঠে গেলাম রুফটপ ডেকে। উপরে উঠে দাঁড়াতেই চোখের সামনে খুলে গেল এক অসীম জলছবি- যতদূর চোখ যায়, কেবল জল আর জল। শান্ত ফিনল্যান্ড উপসাগরে পানি ঘেঁষে কুয়াশা ভাসছে। বাইরে বইছে ঠাণ্ডা বাতাস।
জাহাজ এগোচ্ছে। মাঝে মাঝেই ভেসে উঠছিল ছোট ছোট দ্বীপ। কোনোটায় গাছপালা, কোনোটায় কেবল পাথর। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন কোনও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রূপকথার জলপথে চলেছি, যেখানে প্রকৃতিই কেবল সঙ্গী।
ঘণ্টা দুয়েক পর ফেরি ধীরে ধীরে পৌঁছাতে লাগলো এস্তোনিয়ার দিকে, দূর থেকে অনুভব করে নিচ্ছিলাম মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা টোমপিয়া হিল, আর ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ইতিহাসের ছায়াদের।
এটা যে শুধু ফেরি ভ্রমণ ছিল, তা কিন্তু নয়। এ ছিল এক রেইন-পেইন্টেড মেমোরি- চাকার ঘূর্ণনে জল ফেলে ঢুকে পড়া ভালোবাসার শহরে।
ঝকঝকে নীল আকাশ আর তীব্র বাতাসের প্রবাহের মধ্যে পা ফেললাম তালিনে। আগেভাগে মোটামুটি একটা ভ্রমণ প্ল্যান তৈরি করে রেখেছিলাম। জানা আছে, এই শহরের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে মধ্যযুগের নিঃশব্দ গুঞ্জন, পাথরের রাস্তা, উঁচু টাওয়ার আর প্রাচীন দুর্গ।

অবশ্য বাচ্চার আবদারে প্রথম দিন আমরা পা রাখলাম এক ভিন্ন রাজ্যে, যেখানে রাজা-রানী নয়, বরং পৃথিবীর নানা প্রান্তের বন্য প্রাণীরা অপেক্ষা করছিল।
আমরা পৌঁছালাম তালিন চিড়িয়াখানায় (Tallinn Zoo)। ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই চিড়িয়াখানা প্রথম শুরু হয়েছিল একটি ইউরোপীয় লিঞ্চ নিয়ে, যেটিকে এনেছিলেন একজন এস্তোনিয়ান যোদ্ধা, যিনি বিশ্ব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। আজ এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মাউন্টেন গোট ও শিপ সংগ্রহশালার জন্য বিখ্যাত।
চিড়িয়াখানার প্রবেশদ্বারে দাঁড়ানো মানুষ, পাশেই পোলার বিয়ার আকৃতির মডেল আর বিভিন্ন তথ্যচিত্র। সবকিছুই যেন এক বুনো জগতের দরজা। সেখানে ঢুকেই যেন আমরা ছুঁয়ে ফেললাম পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা প্রাণিকূলের জীবন্ত চিত্রকল্প।
আমরা বাঘ আর হাতির খোঁজে আর না হয় দুই ঘণ্টা হেঁটেছি পুরো চিড়িয়াখানায়। বিচিত্র কোনো কারণে বাঘমামা বের হলেন না, অবশ্য হাতিতে স্বস্তি।

দ্বিতীয় দিনে আমাদের গন্তব্য ছিল তালিন শহর থেকে অল্প দূরত্বেই পার্নু বিচ। রওনা দিলাম মনোমুগ্ধকর শহর পার্নুর (Pärnu) দিকে। শহরটি গ্রীষ্মের রাজধানী হিসেবে খ্যাত, আর তার মূল আকর্ষণ- বিস্তীর্ণ সোনালি বালির পার্নু বিচ।
সেখানে পৌঁছেই চোখে পড়লো এক দীর্ঘ, বাঁধানো হাঁটার পথ। একদিকে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি, অন্যদিকে সবুজ ঘাসে ঢাকা পার্ক ও কাঠের বেঞ্চ। হালকা বাতাস বইছে, সমুদ্রের ঢেউ এসে পড়ছে ধীরে ধীরে পায়ের কাছে। কানে বাজছে শিশুদের হাসির শব্দ, কেউ ঘুড়ি উড়াচ্ছে, কেউ বা সমুদ্রের ধারে বসে প্রেমিক চোখে দেখছে আকাশ।
ফেরার পথে আবার তালিনে ফিরে এসে চললাম শহরের প্রাচীনতম অংশে- কেসকলিন (Kesklinn) অঞ্চলে। এখানেই উঠে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিক টোমপিয়া হিল (Toompea Hill), যার গায়ে লেখা আছে শত শত বছরের ইতিহাস।

এই পাহাড়ে উঠে যেতে যেতে পাশে পড়ে গেল গথিক গির্জা, ছোট ছোট পাথরের পথ, পুরনো ক্যাফে। উপরে পৌঁছে দাঁড়ালাম কহতুয়স্তা ভিউপয়েন্টে (Kohtuotsa Viewpoint)। এখান থেকে পুরো তালিন শহর যেন হাতের মুঠোয়। লাল ছাদের ঘর, দূরের সমুদ্রবন্দর, আর আধুনিক শহরের উঁচু টাওয়ার- সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত চিত্রপট।
পাশেই স্যাক্সোফোন বাজাচ্ছিলেন এক মিউজিশিয়ান, তার সুরে শহরের নিস্তব্ধতা যেন আরো মোহময়। মনে হচ্ছিল, ইতিহাস আর বর্তমান একসাথে এসে দাঁড়িয়েছে এই চূড়ায়।
রাত নামার সাথে সাথে তালিন যেন রূপ পাল্টালো। দিনের কোলাহল মুছে গিয়ে শহর ঢেকে গেল এক গম্ভীর, নীরব চাদরে। কিন্তু সেই নীরবতাও যেন আপন সুরে কথা বলে।
পুরনো শহরের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেখলাম, কাঁচের মতো পাথরের ফুটপাথে প্রতিফলিত হচ্ছে হলুদ স্ট্রিট লাইটের আলো। দেখা গেল আলোয় মোড়া কাঠের ঘর, আর দূরের গির্জার ছায়া যেন দুলছে বাতাসে।

সেইন্ট ওলাফ’স গীর্জার (St. Olaf’s Church) চূড়াটাকে রাতে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছিল, আর আলেকজান্দার নেভস্কির গীর্জা (Alexander Nevsky Cathedral) তখন যেন রূপকথার প্রাসাদ। শহরের প্রতিটি মোড়, প্রতিটি ছায়া যেন একটি করে গল্প। কিছু বলা, কিছু না বলা।
রাতের নিস্তব্দতা যেন বলছে- “আমি কেবল পাথরের শহর নই, আমি অতীত আর সৌন্দর্যের কবিতা।”
তালিন ভ্রমণে আমি বুঝতে পেরেছি একটি শান্ত শহরও কতটা জীবন্ত হতে পারে, ইতিহাসের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা গল্প, সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃশব্দতা, আর রাতের শহরে মিশে থাকা আলো।
এই শহর শুধু দেখার নয়, অনুভব করার মতো।