ট্যারিফ আলোচনা: ইউনূস-খলিল ম্যাজিক, নাকি জনগণের টাকায় পিকনিক?

সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।
সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।

বাংলাদেশ ও বিশ্ব নিয়ে নিয়মিত লিখে আসছেন সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ, যিনি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন এনায়েতুল্লাহ খানের প্রখ্যাত সাপ্তাহিক হলিডে দিয়ে। এরপর সাংবাদিকতার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করে গেছেন কয়েকযুগ। সর্বশেষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ছিলেন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে। সাম্প্রতিককালে সোশাল মিডিয়ায় ‘মিডিয়া ওয়াচ’ শিরোনামে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজের মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছেন এই অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পাঠকের জন্য তার সর্বশেষ লেখাটি হুবুহু তুলে দেওয়া হলো।

ইতিমধ্যে আপনারা জেনেছেন ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের উপর ৩৫ পার্সেন্ট ট্যারিফ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে আগামী পহেলা আগস্ট থেকে। তিন মাস আগে যখন এটার ঘোষণা আসে তখন থেকেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে সে দেশগুলো আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে এটা কমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ৯ জুলাই এই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্প জানিয়ে দেয় আমেরিকা আগে যে ঘোষণা দিয়েছিল সেখান থেকে খুব একটা হের ফের হবে না।

সঙ্গত কারণে অন্যান্য দেশের মতো অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইউনূস সাহেবের অত্যন্ত আস্থাভাজন “সুপার এফিশিয়েন্ট নেগোসিয়েটর” খলিলুর রহমানকে আমেরিকার সঙ্গে দেনদরবার করার জন্য তিন সপ্তাহ আগে ওয়াশিংটন পাঠানো।

ফলাফল কি হয়েছে সেটা ইতিমধ্যে আপনারা জানেন। এ ব্যাপারে আমার মনে বেশ কিছু প্রশ্ন জেগেছে এবং সেটাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।

১। খলিলের টাইটেল হল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে আমেরিকার সঙ্গে এই দেন দরবার করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কাউকে না পাঠিয়ে খলিলকে কেন পাঠানো হলো?

২। খলিলের পদবী অনুযায়ী তার আমেরিকান কাউন্টার পার্ট হবে সেখানকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। এখন এ পদে অধিষ্ঠিত আছেন মার্কো রুবিও, যিনি সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি অন্তত গত তিন সপ্তাহে খলিল তার কাউন্টার পার্টের সঙ্গে কোন বৈঠক করেছে এমন কোন খবর দেশি বা বিদেশি পত্র-পত্রিকায় দেখিনি। রুবিওর সঙ্গে যে তার দেখা হয়নি সেটা আমি নিশ্চিত। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেই যে সে ইউএসটিআর, বা ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ তার সঙ্গে বৈঠক করেছে। সে মন্ত্রী পদমর্যাদার একজন অফিসিয়াল। গত তিন সপ্তাহে ইউএসটিরের সঙ্গে তার কোন বৈঠক হয়েছে এমন কোন খবর কোথাও দেখিনি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে তাহলে সে ওয়াশিংটনে এতদিন থেকে কার সঙ্গে বৈঠক করলো। এর কোন তথ্য প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বা এই দেশের সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করেনি।

৩। এ ব্যাপারটা কেন গোপন রাখা হলো? কেন আমাদেরকে জানানো হলো না কার, কার সঙ্গে সে বৈঠক করেছে? আমি নিশ্চিত সে মন্ত্রী পদমর্যাদার কারো সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। মনে রাখা দরকার যে ইউ এস টি আর বা ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সবাই পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, বিশেষ করে আমেরিকার যারা গুরুত্বপূর্ণ ট্রেডিং পার্টনার–জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া। একই সঙ্গে বলে রাখি বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য খুবই ইনসিগনিফিকেন্ট। আমেরিকা বিক্রি করে দুই বিলিয়ন ডলারের মত প্রোডাক্ট; আর আমরা সেখানে রপ্তানি করি ৮ বিলিয়ন ডলার। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে নিগোশিয়েট করে তারা সময় নষ্ট করতে চায়নি।

তাহলে খলিলের মতো মন্ত্রী পদমর্যাদার লোককে কেন সেখানে পাঠানো হলো? প্রশ্নটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক কেননা এই যে তিন সপ্তাহ ধরে সে ওখানে পাঁচতারা হোটেলে থেকেছে; নানান রকমের টিএ, ডিএ নিয়েছে, এবং বিজনেস ক্লাস ট্রাভেল করেছে এগুলো তো সব এই দেশের ট্যাক্সপেয়ারের টাকা। এটাতো ইউনূস বা অন্য কারো বাপের টাকা না। তার কাজকর্ম দেখে অনেকের মত আমারও মনে হচ্ছে ইনি অন্যান্য স্বৈরশাসকদের থেকে আলাদা না। তিনি তিনি কোন আইন কানুন বা ইথিকসের ধার ধারেন না; তিনি সব জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে।

এবার আসি খলিল প্রসঙ্গে। আমি এই ব্যক্তিকে নিয়ে ‘খলিল উপাখ্যান’ শিরনামে এর আগে তিনটা পোস্ট দিয়েছি।

প্রথমে বলেছিলাম যে এই ব্যক্তি আজ থেকে ২৪ বছর আগে একটা পরকীয়ার সম্পর্কে জড়ায়। ফলশ্রুতিতে সেই মহিলা কর্মকর্তা তার স্বামীর হাতে নিহত হন এবং তার স্বামী নিজে পরে আত্মহত্যা করে। সেই ভয়াবহ ঘটনার ঘটার রাতেই খলিল দেশ থেকে পালিয়ে যায়। ভেবেছিলাম এত বড় ঘটনা হয়তো ইউনুস সাহেব জানতেন না। তখনকার পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। আমি অন্তরবর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ রেখেছিলাম যে ব্যাপারটা আপনারা ইনভেস্টিগেশন করেন এবং তারপর সে যদি নির্দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে কোন কথা নেই।

এ ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশন তো দূরের কথা; এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরও ইউনূস সাহেব খলিলকে রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রেফারেন্সিটিভ নিয়োগ দেয়। তখন বলা হয়েছিল অত্যন্ত মেধাবী এবং যোগ্য এই ব্যক্তি এই সমস্যার অচিরে সমাধান করে দেবে। ফলাফল কি হয়েছে তা আপনারা সবাই জানেন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় আপনি যদি সত্যিকার অর্থে আইনের শাসনে বিশ্বাস করেন তবে এ ব্যাপারে তো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল সর্বপ্রথম। কারন আমরা সব সময় দেখেছি ক্ষমতাধরদের আইন স্পর্শ করতে পারে না।

রোহিঙ্গা প্রজেক্ট ফেল করার পর তাকে হঠাৎ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। আমরা ঠিক এখনও জানি না এই ফিল্ডে তার কন্ট্রিবিউশন কি? গত কয়েক মাসে ইন্ডিয়া থেকে পুশি-ইন করে অনেক বাংলাভাষী ভারতীয়দের এদেশে পাঠানো হয়েছে। ভেবেছিলাম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিশ্চয়ই এখানে ভূমিকা রাখবেন। এ ব্যাপারে তার কোন ভূমিকা আমরা এখনো পর্যন্ত দেখিনি।

এরপর হঠাৎ তাকে দেখা গেল লন্ডন সফরে যেয়ে সে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডন বৈঠকে তাকে খুবই তৎপর দেখা যায়। তখন প্রশ্ন করেছিলাম যে সে কি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দেশীয় রাজনীতির উপদেষ্টা হয়েছেন কিনা? এর কোন উত্তরও ইউনূস সাহেবের অফিস থেকে দেওয়া হয়নি।

এরপর দেখলাম তাকে ওয়াশিংটন পাঠানো হয়েছে বাণিজ্য আলোচনা করার জন্য।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে যে এই ব্যক্তি যার কোন দৃশ্যমান সফলতা কোন সেক্টরে নেই তাকে বারবার এইভাবে হাইলাইট করা হচ্ছে কেন?

তাতেও আমাদের আপত্তি ছিল না, যদি সে দেশের ট্যাক্সপেয়ারের টাকা খরচ করে এই তথাকথিত বিভিন্ন নেগোসিয়েশনের নামে পিকনিক করে না বেড়াতো।

সংবাদ মাধ্যমের জন্য এটা তো সবচেয়ে বড় খবর হওয়ার উচিত ছিল। দুঃখের বিষয় আজ পর্যন্ত কোন টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্র এটা নিয়ে কোন রিপোর্ট করেনি। অন্তত খলিল এ পর্যন্ত কতবার বিদেশে গেছে এবং তার পেছনে রাষ্ট্রের কত টাকা খরচ হয়েছে এটা জানার অধিকার তো দেশের মানুষের আছে।

কষ্ট পাই যখন দেখি সংবাদ মাধ্যম তার মূল দায়িত্ব পালন না করে ব্যক্তি পূজা এবং বন্দনায় ব্যস্ত। অন্যান্য পত্রপত্রিকার কথা বলতে পারি না। কিন্তু প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার, যারা নিরপেক্ষ এবং নির্ভীক হিসেবে দাবি করে, তারা এটা নিয়ে কোন রিপোর্ট করছে না কেন? ক্ষমতাধরদের জবাবদিহিতা আদায় করা তো সংবাদ মাধ্যমের মৌলিক দায়িত্ব।

এ সংক্রান্ত আরও খবর:

আরও পড়ুন