প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের ঢাক বাজতেই গুঞ্জন উঠছিল, লন্ডনে তার সঙ্গে বৈঠক হবে তারেক রহমানের। কিন্তু কোন তরফেই খবরটি স্বীকার করা হচ্ছিল না।
শেষে ইউনূস যখন লন্ডনে পা রাখলেন, তারপরই হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার ঢাকায় সাংবাদিকদের ডেকে জানালেন, বৈঠকটি হচ্ছে। আর তিন দিন বাদে শুক্রবার তাদের দুজনের সাক্ষাৎ হবে।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করছেন ইউনূস। ফলে দেশের বড় দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার বৈঠক হতেই পারে।
কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউনূস বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোনো বৈঠক করেননি। এখন তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠক করতে হচ্ছে কেন?
কিংবা নির্বাচনের সময় নিয়ে যখন দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব চলছে, তখন তারেক রহমানের সঙ্গে ইউনূসের বৈঠকটি আসলে কার আগ্রহে হচ্ছে?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিলেও বিএনপি আগে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি করে আসছিল, সেই সরকারের প্রধান হিসাবে ইউনূসকেই ভেবে রেখেছিল।
সেই কারণেই ইউনূসের ওপর শেখ হাসিনার ক্ষোভ ছিল বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে। সেই ক্ষোভে ইউনূসের জেলে যাওয়ার উপক্রমও হয়েছিল।
গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় গত বছরের জানুয়ারিতেই ইউনূসের কারাদণ্ডের রায় এসেছিল বিচারিক আদালত থেকে। তবে আপিলের শর্তে জামিন পাওয়ায় তাকে চৌদ্দ শিকে ঢুকতে হয়নি।
তার সাত মাসের মধ্যে এক অভ্যুত্থানে গোটা পরিস্থিতি বদলে যায়। শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে, আর প্যারিস থেকে উড়ে এসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার শপথ নেন ইউনূস। তার আগেই বাতিল করা হয় দণ্ডের রায়টি।
এক্ষেত্রে ইউনূসের সঙ্গে মিল আছে তারেক রহমানেরও। আওয়ামী লীগ আমলে দেশে ফিরলে তাকেও জেলে যেতে হত। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলাসহ চারটি মামলায় কারাদণ্ডের রায় ঝুলছিল তার নামের সঙ্গে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সেই দণ্ডগুলো থেকে খালাস পেয়েছেন তিনিও। তবে নির্বাসিত জীবন থেকে এখনও দেশে ফেরেননি তিনি। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, তার ফেরার পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু শঙ্কাটি যে কোথায়, তা খোলাসা করছেন না তারা।

ইউনূস সরকার শপথ নেওয়ার পর তাকে সমর্থন এবং সব ধরনের সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তারেক। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে, এই সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব ততই বাড়ছে।
ইউনূস শুরু থেকে বলে আসছিলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। ন্যূনতম সংস্কার হলে ডিসেম্বরে, আর ব্যাপক সংস্কার হলে জুনে নির্বাচন হবে।
বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে। তারমধ্যে আদালতের রায়ের পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর উদ্যোগ না নেওয়ায় সরকারের সঙ্গে বিএনপির দ্বন্দ্ব বাধে।
এই পর্যায়ে এসে অন্তর্বর্তী সরকারকে আর সহযোগিতা করবে না বলেও হুমকি দেয় বিএনপি। তখন ইউনূসের পদত্যাগের একটি গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এটাও বলেন, প্রয়োজনে বিকল্প খুঁজে নেবে জনগণ।
এরপর তারেক রহমান নির্বাচন নিয়ে সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, “আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মনে হয় এরই ভেতরে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।
“জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।”
এরপর ইউনূস নির্বাচনের সময় এগিয়ে আগামী বছরের এপ্রিলে আনার কথা বললেও ‘ইন্টেরিম রিমেম্বার, ইলেকশন ইন ডিসেম্বর’ দাবি থেকে এখনও সরে আসেনি বিএনপি।
তার মধ্যেই লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চলেছেন ইউনূস। আবার সেনই বৈঠক বাংলাদেশের রাজনীতির ‘টাির্নং পয়েন্ট’ হবে বলে মনে করছেন ফখরুল।
বিএনপির সঙ্গে দ্বন্দ্ব যদি মেটাতে হয়, তবে যে কারো আলোচনাটি যে তারেকের সঙ্গেই করতে হবে, তা জানা কথা। কারণ খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর ছেলে তারেকই দলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, এখন মুক্তি পেলেও তার অসুস্থতার কারণে দল তারেকই চালাচ্ছেন।
কিন্তু তারেকের সঙ্গে বৈঠক করে ঠিক কী অর্জন করতে চাইছেন ইউনূস?
বৈঠকটি নিয়ে সরকারের কেউই মুখ খুলছেন না। ইউনূসের লন্ডনের কর্মসূচিতে তারেকের সঙ্গে বৈঠকের কোনো কথা নেই। পররাষ্ট্র সচিব রুহুল আলম সিদ্দিককে গত ৪ জুন সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, তারেকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের কোনো তথ্য তার কাছে নেই।
কিন্তু মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের জানালেন, ১৩ জুন শুক্রবার লন্ডনে ইউনূস যে হোটেলে উঠবেন, সেই হোটেল ডরচেস্টারে বৈঠকটি হবে।
সেই দিন যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্সের ডেপুটি লিডারসহ আরও কয়েকজনের ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে। তাদের আগেই তারেকের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।
সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা না হলেও বিএনপি মহাসচিব বলছেন, সরকারের উদ্যোগেই এই বৈঠক হচ্ছে।
সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এই বৈঠক আয়োজনের বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল বলে বিএনপির সূত্রে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বৈঠকের উদ্যোগটা আমাদের পক্ষ থেকে ছিল না। যেহেতু প্রধান উপদেষ্টা ব্রিটেন যাচ্ছেন, তিনি মনে করেছেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করবেন। এটা একটা সৌজন্যতা। দেখা করবেন না বললে তো মানুষ ঠিকভাবে নেবে না।”
বিএনপি সূত্রগুলো জানাচ্ছে, প্রথম দিকে এই বৈঠকের বিষয়ে বিএনপির আগ্রহ ছিল না। তবে নির্বাচন সময়ের প্রশ্নে আলোচনা হতে পারে, সেই ধারণা থেকে সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা আলোচনা করে এই বৈঠকে সায় দেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জুলাই সনদ, স্থানীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে টানাপড়েনের পর এখন জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়েই বিএনপির বিরোধ।
অভ্যুত্থানকারী তরুণদের সমর্থনে গঠিত ইউনূস সরকারকে এখন ভাবতে হচ্ছে বিএনপির সমর্থনের বিষয়টি। কারণ অভ্যুত্থানকারীরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেও রাজনীতির মাঠে এখনও হালে পানি পায়নি। বরং নানা কাণ্ডে তারা পড়েছে সমালোচনায়।
এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহেই লন্ডনে এই বৈঠকের আয়োজন বলে সরকারের কয়েকটি সূত্র বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু যে বৈঠকে বিএনপির আগ্রহই ছিল না, সেই বৈঠককে ফখরুলের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলার মানে কী, সেই প্রশ্নও আসছে অনেকের মনে।
তার উত্তরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “ইতোমধ্যে জানেন, পত্র-পত্রিকায়, সাংবাদিকদের মধ্যে বহু আলোচনা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলছে। এর মধ্যে এই মিটিংটা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে এবং অনেক কিছু সহজ হয়ে যেতে পারে, নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি হতে পারে…সম্ভাবনা অনেক।”
নিষিদ্ধ হওয়ায় আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে নেই। এখন বিএনপিকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার যে এগোতে পারবে, তা মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। তাই তারা মনে করছেন, দলটির সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করার উদ্দেশ্যেই এই বৈঠক আয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী মারুফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বর্তমানে সরকারের সাথে বিএনপির যে আস্থার সঙ্কট চলছে, সেটা নিরসন হওয়া দরকার। সেটা দলের চেয়ে দেশের স্বার্থেই বেশি প্রয়োজন।”
বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে, এই বৈঠকে তারেক রহমান আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের কথা তুলতে পারেন।
মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে ফখরুল এবিষয়ে বলেন, আগামী বছরের এপ্রিল সময়টা নির্বাচনের উপযোগী নয়। কারণ তার ঠিক আগেই ঈদ হবে। এটা অন্তর্বর্তী সরকারেরও বুঝে আসবে বলে তারা মনে করেন।
তাহলে হতে পারে তারেক রহমান নির্বাচনের সময় এগিয়ে আনতে রাজি করাবেন ইউনূসকে; আর ইউনূস তার সরকারের ওপর বিএনপির সমর্থন ধরে রাখতে তারেক রহমানের প্রতিশ্রুতি আদায় করবেন। এটাই হতে পারে লন্ডন বৈঠকের সম্ভাব্য ফল।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: