বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি বাতিল, বদলে গেল মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা

রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের একটি মুহূর্ত।
রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের একটি মুহূর্ত।

একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর বাঙালিদের স্বীকৃতিতে কাটছাঁট, সংযোজন ও বিয়োজন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী কার্যত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বীকৃতিতেও আসবে পরিবর্তন।

মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনের সংশোধনীতে যেসব স্থানে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ লেখা ছিল তাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।

অবশ্য বুধবার বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতাসহ মুজিবনগর সরকারের নেতাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি বাতিলের খবরটি ‘সঠিক নয়’ বলে দাবি করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম।

সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা সঠিক নয়। সঠিক নয় এই অর্থে যে এখানে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)। মুজিবনগর সরকার লেখা আছে, তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন, মনসুর আলী সাহেব ছিলেন, কামারুজ্জামান সাহেব ছিলেন, খন্দকার মোশতাক সাহেব ছিলেন, এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।”

সংশোধিত অধ্যাদেশে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) ও এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য), যারা গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন, এখন থেকে তারাও একই ক্যাটাগরিতে পড়বেন।

নতুন এই অধ্যাদেশের ফলে ৫৪ বছর ধরে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসা এমন অনেকে খাতায় কলমে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হয়ে যাবেন বলেই প্রতীয়মান।

এর ফলে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের (এমএনএ-এমপিএ) মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি কার্যত বাতিল করল ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

অধ্যাদেশে সহযোগীদেরকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং বাংলাদেশের যেসব নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত, মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ, যারা পরবর্তী সময়ে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন, চতুর্থত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং সর্বশেষ শ্রেণিতে রয়েছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের নারীদের নির্যাতনের চিত্র ফুটিয়ে তুলে এই ম্যুরাল ছিল মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে। ফাইল ছবি।

এর আগে গত ১৫ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অধ্যাদেশটি শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ওই সভায় বলা হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে। সেসব পরিবর্তন শেষে মঙ্গলবার রাতে অধ্যাদেশ জারি করে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।

বীর মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা দেশের ভেতরে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সব বেসামরিক নাগরিক (ওই সময়ে যাঁদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল) তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

এর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও সেই সরকার স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্যরাও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

নতুন সংজ্ঞায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীর মাধ্যমে নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা) বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা সহকারীরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

(সর্বশেষ উপদেষ্টার বক্তব্য যুক্ত করা হয়েছে)

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন