আজ সেই ভয়াল ২১ আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের দিন। ২১ বছর আগে এইদিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারান আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী; আহত হন অগুনতি।
মানববর্ম তৈরি করে দলের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে পারলেও অনেকের মতো তিনিও সেদিনের ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দিনটি ঘিরে নানা কর্মসূচি থাকলেও ক্ষমতার পালা বদলে এবার দিনটি যেন অতলে হারাতে বসেছে। কোনঠাসা আওয়ামী লীগ নিজেদের ফেইসবুক পেইজে বিবৃতি দিলেও তাদের কোনো কর্মসূচি চোখে পড়েনি।
ছয়দিন আগেই ১৫ আগস্টে শোক দিবস পালন নিয়ে সরকারের কড়া বার্তা আর বিএনপি ও তাদের সমমনা দলের নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের যে চিত্র দেখেছে দেশের মানুষ তাতে বোধ করি আর যাই হোক কর্মসূচি পালনের ফাঁদে পা দেওয়ার সাহস হয়তো করতো না অনেকেই।
সেদিন কীভাবে শান্তির মিছিল এক লহমায় বদলে গেল রক্তাক্ত আর ছিন্নভিন্ন মানুষের আর্তনাদে, কীভাবে রূপ নিল মৃত্যুপুরীতে- সে স্মৃতি আজও ঘুরেফিরে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে। বিভীষিকার মাত্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা জাতি।
মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটিই ছিল সবচেয়ে মর্মান্তিক ও বিভীষিকাময় ঘটনা। অনেকের মতে, ২১ আগস্টের নৃশংসতার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজনের সূচনা হয়েছিল।
গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে ২৪ জন নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছিলেন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। খবর কভার করতে যাওয়া প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরাও রেহাই পাননি। অনেকে এখনও স্প্লিন্টারের আঘাত নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই বলে আসছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় সেসময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই যে ছিল সেই হামলার উদ্দেশ্য। যা পরে উঠে আসে আদালতের রায়ে; যাতে সেই সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর-এমপির সঙ্গে দণ্ডিত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান।
অবশ্য ক্ষমতার পট পরিবর্তনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সেই রায় কিংবা দণ্ড এখন কেবলই অতীত। কারণ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা পৃথক মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা) বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল করে গত বছরের ১ ডিসেম্বর রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। ফলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিরা ইতোমধ্যে খালাস পেয়েছেন।
এর ফলে ওই হামলায় নিহত ২৪ জন ছাড়াও আহত অগুনতি নেতাকর্মী, সাংবাদিক, সাধারণ মানুষের ক্ষতের পেছনে যাদের হাত ছিল তারা অধরাই রয়ে গেল দুই দশকের ব্যবধানেও।
কী ঘটেছিল সেদিন?
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট জনাকীর্ণ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে থাকা সাংবাদিকদের বিবরণ অনুযায়ী, সেদিন বিকাল ৩টা থেকে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন দলের মধ্যম সারির নেতারা। ৪টার দিকে শুরু হয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তৃতার পালা। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা আসেন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে। যে ট্রাকে সমাবেশের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, তার পেছনে বাঁ দিকে একটি সিঁড়ি ছিল উপরে ওঠার জন্য। ট্রাকের শেষ মাথায় ডানদিকে রাখা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন নেতারা।
শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু হয় বিকাল ৫টা ২ মিনিটে। তার দুই পাশে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
পুরোটা সময় ওই টেবিলের পাশে বসেছিলেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আব্দুল্লাহ আল মামুন। মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির কয়েক গজের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ গাড়ি। সেখানে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা।
৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয়। ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ট্রাকের উপর বসিয়ে দেন।

এর পরপরই আরও তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে চারদিকে ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব মো. তারিকুল্লাহ ট্রাকের সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নামিয়ে আনতে বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতিকে।
আওয়ামী লীগ নেতা মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে নামিয়ে নেওয়ার সময় আরেকটি গ্রেনেড ট্রাকের পেছনের ডালায় বাড়ি খেয়ে পাশেই বিস্ফোরিত হয়। ফলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আবার সবাই ট্রাকের উপর বসে পড়তে বাধ্য হন।
নেতা-কর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা সেখানে শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি করেন মানববর্ম। কিন্তু শোয়েব নিচ থেকে জানান, বিস্ফোরণে ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যেতে পারে।
শেখ হাসিনার পায়ের স্যান্ডেল তখন কোথায় ছিটকে গেছে, চশমাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ওই অবস্থায় মামুন, শোয়েব এবং নজিব আহমেদসহ অন্যরা মিলে তাকে নিয়ে গাড়ির সামনে বাঁ দিকের আসনে বসিয়ে দেন।
সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে আহত নেতাকর্মীদের ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না শেখ হাসিনা। অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে বাসভবন সুধা সদনে নিয়ে যাওয়া হয়।
শেখ হাসিনা যখন সেই স্থান ছাড়ছিলেন, তখনও গ্রেনেড ফাটানো হচ্ছিল, পাওয়া যাচ্ছিল গুলির শব্দ।
ওই হামলা আর বিস্ফোরণের পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নেতা-কর্মীরা। ওই অবস্থায় রিকশা, অটোরিকশা, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। কেন্দ্রীয় নেতা আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের, যার মাথায় স্প্লিন্টার বিঁধেছিল। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।
২১ অগাস্ট হামলায় নিহতরা– আইভি রহমান, শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মোহাম্মদ হানিফ, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় জানা যায়নি।
সেদিন গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হন তারেক আহমেদ সিদ্দিক, নজিব আহমেদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শোয়েব মো. তারিকুল্লাহসহ অনেকে।
সেদিনই টেলিফোনে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমার কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। গ্রেনেড যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন নেতা-কর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিল| তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। এখনও আমার কাপড়ে তাদের রক্ত লেগে আছে।”
‘টার্গেট’ ছিলেন শেখ হাসিনা
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন বাঁচতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই সেদিন করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের দাগ, গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের চিহ্ন আর পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির চাকা সে কথাই প্রমাণ করে।
সুধা সদনে শেখ হাসিনার বাসভবনে গাড়িটি দেখিয়ে দলের তখনকার সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী পরদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থার গাড়িটিই শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

তিনি বলেন, গ্রেনেড হামলার পরপরই নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ঘিরে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে যান। আর তখনই গাড়ির সামনের জানালা লক্ষ্য করে অনেকগুলো গুলি ছোড়া হয়। দেহরক্ষী মাহবুব তখনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
শেখ হাসিনা গাড়িতে ওঠার পরপরই পেছন থেকে বাঁ দিকের সিট লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়। সব শেষে চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে হামলাকারীরা।
কিন্তু চালক মোহাম্মদ আব্দুল মতিন সচিবালয়ের সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে শহীদ মিনার, পলাশী, নিউ মার্কেট হয়ে পিলখানার ভেতর দিয়ে নিরাপদেই ধানমণ্ডিতে সুধা সদনে পৌঁছে দেন শেখ হাসিনাকে।
তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, সমকাল, যুগান্তর, বিবিসি