জাতীয় চার নেতা: নীরবে অমর্ত্যলোকে যাত্রা

জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী
জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী

১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর। বাংলার ভাগ্যাকাশে কালোমেঘ হানা দিলেও সেদিনকার আবহাওয়া ছিলো বেশ চনমনে। আমি ঘেটেঘুটে দেখেছি। তাপমাত্রাও ছিল মোটামুটি স্বস্তিদায়ক।

জানা হয়নি বাতাসে বর্ষার স্নিগ্ধ আর্দ্রতার স্পর্শ ছিল কিনা। জানা হয়নি দিগন্ত ছড়ানো সূর্যরশ্মি কারাগারের চৌদ্দ শিক ভেদ করে সেল অবধি পৌঁছেছিলো কিনা সেদিন!

অথচ সেদিনের শেষরাতে কতিপয় সেনা সদস্যের ছোড়া বুলেট ঠিকই ভেদ করে গিয়েছিল বাংলার চার জাতীয় নেতার দেহ। জানা হয়নি তাদের শেষ কথার মর্মার্থ। বুলেটবিদ্ধ দেওয়ালগুলোই যেন সাক্ষী হয়ে রয়েছে যুগের পর যুগ।

বলছি সেই ৩ নভেম্বরের নৃশংস হত্যার কথা।

অবাক হলেও সত্য যে ঘটনার পরদিন কোনো পত্রিকায় সেই হত্যার ঘটনা স্থান পায়নি। পাবে কীভাবে। পরদিন বিকেল পর্যন্ত তো পরিবারের লোকজনকেও জানানো হয়নি জাতির চার বীর তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে হত্যার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা।  

৫ নভেম্বর ইত্তেফাকে সংবাদটি আসে “ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও তাজুদ্দীন নিহত” এই শিরোনামে।

তিন কলামের সেই খবরে জানানো হয়- ‘তাঁহাদের লাশ গতরাত্রে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বিশেষ ব্যবস্থাধীন ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়। ইহার পর গতকাল রাত্রি পৌনে দুইটার সময় আত্মীয় স্বজনদের নিকট তাহাদের লাশ ফিরাইয়া দেওয়া হয়।’

ওই খবরের নিচেই দুই কলামের আরেকটি খবর প্রকাশ করা হয় যার শিরোনাম ছিলো- “বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন”।

তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে উদ্ধৃত করে বলা হয়- কেন্দ্রীয় কারাগারে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত বলে যে খবর ছড়িয়ে পড়েছে তা নিতান্তই গুজব।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের মেয়ে শারমিন আহমদ তার ‘৩ নভেম্বর জেল হত্যার পূর্বাপর’ স্মৃতিকথায় তুলে ধরেন সেই সময়ের নানা ঘটনা। ৫ নভেম্বরের বর্ণনা দিয়ে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন সেই সময়ের ‘গুজব’ প্রসঙ্গে!

“আমার জীবনে এ কী ঘটে গেল? কেন এমন ঘটল? আব্বু নেই। এ পৃথিবী ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই শুনছিলাম আব্বুকে নাকি রোববার (দিবাগত) রাতে জেলে ঢুকে গুলি করে মেরেছে। আমি বিশ্বাস করিনি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছি।

”ভেবেছি আব্বুকে মারবে কেন? মারবে কেন? হাসান ভাই (আমাদের ভাতৃসম পারিবারিক বন্ধু) ও আমি রিকশায় চড়লাম। আব্বুর খবর শুনলাম। আম্মা, ছোট বোন রিমি ও আমি সারাদিন ধরে পাগলের মতে ঘুরছিলাম জেলে হত্যাকাণ্ডের গুজবের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য।

”হত্যাকাণ্ডের পর দুই দিন পর্যন্ত সরকারি প্রশাসন ও মিডিয়া এই বিষয়ে নীরব থাকে। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। বাসায় এলাম। ঘরে গেলাম। চিৎকার করে সবার আড়ালে কাাঁদলাম। কাঁদবার পর যেন পথ দেখতে পেলাম। আব্বু যেন হাসছে, বলছে ‘চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে’! মনকে শক্ত করলাম। যতক্ষণ লাশ না দেখেছি, বিশ্বাস করতে পারিনি। লাশ এল। দেখলাম। সবার সাথে কাঁদলাম।”

বিবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলারের ভাষ্যে তুলে ধরে ওই রাতের ঘটনা প্রবাহ।  

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। তখন রাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটা। ঢাকা তখন এখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন।

জেলার আমিনুর রহমান ছিলেন পুরো ঘটনাচক্রের ‘প্রত্যক্ষদর্শী’।

বিবিসি লিখেছে, রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার আমিনুর রহমানকে তাৎক্ষণিকভাবে আসতে বলেন। মূল ফটকে গিয়ে আমিনুর দেখলেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনা সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় আছে।

এক পর্যায়ে কারাগারে থাকা তৎকালীন আওয়ামী লীগের চার জন নেতাকে একত্রিত করার আদেশ আসে।

আমিনুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন। আর ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে অপর কক্ষ থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়।

“তাজউদ্দীন সাহেব তখন কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ওনারা কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করলেন না আমাদের কোথায় নেও (নেয়া হচ্ছে)? সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হাত-মুখ ধুলেন। আমি বললাম আর্মি আসছে।”

চারজনকে যখন একটি কক্ষে একত্রিত করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগায় সেনাসদস্যরা কারা কর্মকর্তাদের নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করছিল, বলে উঠে এসেছে আমিনুর রহমানের ভাষ্যে।

“মনসুর আলি সাহেব বসা ছিল সর্ব দক্ষিণে। যতদূর আমার মনে পড়ে। আমি মনসুর আলীর ‘ম’ কথাটা উচ্চারণ করতে পারি নাই, সঙ্গে সঙ্গে গুলি,” বলেন আমিনুর রহমান।

কারাগারের ভেতর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেননি, যা জোহরা তাজউদ্দীনের মেয়ের স্মৃতিকথায়ও উঠে এসেছে।

খবরের পাতা যেমন ছিল নীরব, নিশ্চুপ, তেমনি নীরবেই অমর্ত্যলোকে যাত্রা করেছিলেন জাতীয় চার নেতা, বাংলার সূর্যসন্তানরা।   

আরও পড়ুন