প্রায় দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর পদত্যাগ করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো; যিনি উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সোমবার শুধু দেশের শাসনভার নয়, কানাডার ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির নেতার পদ থেকেও পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য শুল্কের হুমকির পর তা মোকাবেলার উপায় নিয়ে মতবিরোধের জেরে অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের আকস্মিক পদত্যাগে সংকটে পড়েন ট্রুডো।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো জানান, লিবারেল পার্টির ‘অভ্যন্তরীণ সংঘাত’ রয়েছে। এর ফলে আগামী নির্বাচনে ‘সেরা বাছাই হবেন না’ তিনি।
নিজ বাসভবন রিডো কটেজের বাইরে ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ছুটির মধ্যে এ বিষয়ে তিনি পরিবারের সঙ্গে ‘আলাপ-আলোচনা’ করেছেন।
ট্রুডো বলেন, “আমার কর্মজীবনে আমি যা কিছু অর্জন করেছি সবই তাদের সমর্থন এবং উৎসাহে।”
তিনি বলেন, “গতকাল রাতের খাবারের সময় বাচ্চাদের যে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছি, তা আজ আপনাদের বলছি। দল দেশজুড়ে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় একজন বলিষ্ট নেতা নির্বাচনের পর আমি পার্টি লিডার ও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
একসময় উদারপন্থী রাজনীতির প্রতীক ট্রুডোর জনপ্রিয়তা সম্প্রতি কমে যায়। এ বছর বেশ কয়েকবার জরিপে তার জনপ্রিয়তা ৩০ শতাংশের নিচে নেমে যায়।
এই এক দশকের চলার পথ কেমন ছিল। কোথায় ভুল ছিল?
উজ্জ্বল এক তরুণ প্রতিভার উত্থান
মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন জাস্টিন ট্রুডো। তিনি কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর ছেলে।
২০১৩ সালের কানাডার মধ্য বামপন্থি লিবারেল পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার আগে পার্টির কাজ ছাড়াও বিভিন্ন দাতব্য সংস্থায় শিক্ষা বিষয়ক কাজ করতেন তিনি।
দুই বছর পর ফেডারেল নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দেন এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিকে হারিয়ে জয়ী হন।
২০১৫ সালে যখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী হন তখন মাত্র ৪৩ বছর বয়স ট্রুডোর। তিনি দেশটির ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্ব কনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
সেই বছর ‘কানাডিয়ান রাজনীতির নতুন তরুণ মুখ’ শিরোনামে ট্রুডোকে নিয়ে প্রচ্ছদ করে বিখ্যাত ভোগ ম্যাগাজিন। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমও তাকে ‘অত্যন্ত আকর্ষণীয়’ বলে অভিহিত করে।
ক্ষমতা থাকাকালীন ট্রুডো সরকারের আলোচিত নীতির মধ্যে ছিল ২০১৬ সালে স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ, ২০১৮ সালে গাঁজাকে বৈধ করা এবং ২০১৮ সালে কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করা।
এছাড়াও আবাসিক স্কুলগুলোতে আদিবাসী কানাডিয়ানদের ওপর হওয়া নিপীড়নের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন এবং হাজার হাজার শরণার্থীকে স্বাগত জানিয়েছেন ট্রুডো।
ব্ল্যাকফেস কেলেঙ্কারি
জনপ্রিয়তা জরিপে ৬৩ শতাংশ ভোট থাকলেও ২০১৯ সালে ‘ব্ল্যাকফেইস স্ক্যান্ডালের পর তার ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই সময়ে ট্রুডোর মুখ কালো বা বাদামী করা একটি ভিডিও এবং ছবি প্রকাশ পায়। উনিশ শতকের ৯০ দশকের এবং ২০০১ সালের দিকের ওই ছবি ও ভিডিও তার উদারপন্থী এবং প্রগতিশীল রাজনীতিবিদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে।
ছবিতে দেখা যায় ২৯ বছরের ট্রুডো অ্যারাবিয়ান নাইটস পার্টিতে আলাদিনের চরিত্রের জন্য মুখ বাদামি রঙের করেছিলেন। আর হাইস্কুলে জ্যামাইকান ফোক গান ‘ডে-ও’ পরিবেশনের সময় মুখে কালো রং করেন। পরে তিনি স্বীকার করেন যে এমন আর কিছু ঘটেছিল নাকি তিনি মনে করতে পারছেন না।
সংখ্যালঘু সরকার এবং কোভিড
২০১৯ সালের নির্বাচনে ট্রুডো দল লিবারেল পার্টিকে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রশাসনে তার সরকার সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।
এর দুই বছরের কম সময় পর কোভিডের চতুর্থ ধাক্কার মধ্যে আবার একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন করেন ট্রুডো। তার ধারণা ছিল অতিমারীর মোকবেলা এবং ভ্যাকসিন দেওয়ার উচ্চ হার নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দেবে। তবে এবারও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হন তিনি।
এছাড়া স্বেচ্ছায় মৃত্যুর আইন, যা বিশ্বের সবচেয়ে উদার স্বেচ্ছামৃত্যু আইনগুলির মধ্যে একটি সেটিও নিয়েও ২০২২ সাল থেকে তীব্র চাপের মুখে পড়েন ট্রুডো। ব্যবস্থাটিকে গভীরভাবে পর্যালোচনার প্রয়োজন দাবি করে বলা হয় সরকারি সহায়তার মাধ্যমে তাদের সমস্যা প্রশমিত করার বদলে মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে।
অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ানো, বাড়ির দাম বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে গত কয়েক বছর ধরেই ট্রুডো অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এক জনমত জরিপে দেখা যায় ৭০ শতাংশের বেশি কানাডিয়ান মনে করেন তার নেতৃত্বে দেশটিতে ‘ভাঙন’ ধরেছে।
এই বছরের অক্টোবর মাসে, ট্রুডো ঘোষণা করেছিলেন যে কানাডা ২০২৫ সালে স্থায়ী অভিবাসন ২১ শতাংশ কমিয়ে পাঁচ লাখ থেকে ৩ লাখ ৯৫ হাজার করবে। তিনি স্বীকার করেন যে সরকারের আগের উদ্দেশ্যটি ‘সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি।’
ট্রাম্পের শুল্ক সমস্যা
নভেম্বরে ট্রাম্প দ্বিতীয় দফা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই ঘোষণা করেন যে কানাডার থেকে আসা পণ্যগুলোর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। তিনি কানাডাকে অভিবাসন বিষয়ে চাপ দিতে করের হুমকি দিতে চান; আর তা করতে চান দেশটি থেকে রপ্তানি পণ্যের দাম মার্কিন বাজারে বাড়িয়ে দিয়ে।
রাজনৈতিক চিন্তার বিপরীত প্রান্তে থাকা ট্রাম্প এবং ট্রুডো কখনও একমত হতে পারেননি। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট-ইলেক্টে স্টেট মার-এ-লাগোতে এক নৈশভোজ বৈঠক শেষে ট্রুডোকে ‘গভর্নর জাস্টিন ট্রুডো, গ্রেট স্টেট অফ কানাডা’ বলে বিদ্রুপও করেন ট্রাম্প।
গত ১৬ ডিসেম্বর কানাডার চলতি অর্থনৈতিক পরকিল্পনা প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা আগে পদত্যাগ করেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। পদত্যাগের আগে ট্রাম্প প্রশাসন মোকবেলায় ট্রুডোর ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ট্রুডো এ ঘটনাকে লিবারেল পার্টির ‘সবচেয়ে কঠিন’ দিনগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেছিলেন; যা পরে তাকেও পদত্যাগের পথে নিয়ে যায়।
সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডোকে ফ্রিল্যান্ড বিষয়ে প্রশ্নও করা হয়।
ট্রুডো তাকে প্রায় এক দশকের ‘অসাধারণ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা’ হিসেবে প্রশংসা করলেও তার পদত্যাগে হতাশা জানান।
তিনি বলেন, “ক্রিস্টিয়া আমার পাশে প্রায় ১০ বছর ধরে ছিলেন। গত এক দশকে আমরা সরকার বা পার্টি হিসেবে যা কিছু করেছি তার সবকিছুর মধ্যেই এক অসাধারণ রাজনৈতিক সঙ্গী ছিলেন তিনি।”
সেইসঙ্গে তিনি এও বলেন, “আমি সত্যিই আশা করেছিলাম যে তিনি উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন এবং সরকারের নয়, বরং দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন; কিন্তু তিনি অন্য কিছুই করলেন।”
স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ
বিয়ের প্রায় দুই দশক পর ২০২৩ সালের অগাস্টে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন জাস্টিন ট্রুডো এবং সার স্ত্রী সোফি গ্রেগরি।
তারা ২০০৫ সালে বিয়ে করেন এবং জেভিয়ার, এলা গ্রেস ও হ্যাড্রিয়েন নামে তাদের তিন সন্তান রয়েছে।
ট্রুডো তখন লিখেছিলেন- “সোফি এবং আমি জানাতে চাই যে, অনেক আলোচনা-পর্যালোচনার পর আমরা আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তবে এ বছরের শুরুর দিকে সাবেক বিনোদন সাংবাদিক গ্রেগরি তাদের বিচ্ছেদকে ‘বেদনাদায়ক’ বলে মন্তব্য করেন।
নেক্সট কোয়েশ্চেন উইথ কেটি কুরিক নামে এক পডকাস্টে প্রেগরি বলেন, “এটি গভীরভাবে যন্ত্রণা দেয়। আমাদের ভাষায় দুটি শব্দ রয়েছে বিবাহ হল ‘সাফল্য’আর বিচ্ছেদ ‘ব্যর্থতা’।
“কিন্তু এটা জীবনে ঘটে। কারণ অসুস্থতা এবং একা থাকার ভয়ে আমরা সম্পর্কগুলোকে নাটুকে করে তুলি। মানুষ হিসেবে আমাদের একা থাকতে ভালো লাগে না; একা বাঁচা আমাদের স্বভাবের বাইরে।”
বিচ্ছেদের আগে মেগান মেরকেলের স্পটিফাই পডকাস্ট ‘আর্কেটাইপস’ গ্রেগরি যে মন্তব্যগুলো করেন তাদের আলাদা হওয়ার ঘোষণার পর সেগুলো আবার প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি পরিবারে মাতৃত্বের প্রথাগত ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “পৃথিবীর সব নারী এখনও পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু, তারা এখনও বেশিরভাগ গৃহস্থালীর কাজের ভার বহন করেন, পরিবারের দেখভাল এবং বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন।
“কিন্তু আমি মনে করি আমাদের সবার মধ্যে সেই সিংহী বাস করে এবং আমরা সবাই নিজের সত্যিকারের পরিচয়ে মুক্ত হতে চাই।”
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট অবলম্বনে মাহবুবা ডিনা
এ সম্পর্কিত খবর: