দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত রাষ্ট্রপতির সমর্থকদের হাতে কেন মার্কিন পতাকা?

ইউনের সমর্থকদের হাতে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিন কোরিয়ার পতাকা।
ইউনের সমর্থকদের হাতে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিন কোরিয়ার পতাকা।

অভিশংসিত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে রীতিমতো ‘পর্যদুস্ত’ হয়ে ফিরতে হয়েছে তদন্তকারী দলকে। হাজারো সমর্থকের ঢাল ভেদ করতে না পেরে শেষমেশ ঘোষণা দিতে হয়েছে, ‘আরও পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে’।

ইউনের আইনি প্রক্রিয়ায় বাধাদানকে ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করতেও ছাড়েননি তারা।

প্রশ্ন হলো এই যে হাজারো সমর্থক, তাদের হাতে কেন দেখা গেল দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা? এভাবে দুই দেশের পতাকা ওড়ানো দেখে অনেকেই অবাক হতে পারেন, তবে এর মাধ্যমে যে বার্তা দিতে চেয়েছেন তাতে শতভাগ সফল হয়েছেন ইউনের সমর্থকেরা।

মূলত ইউন সুক-ইওলের সমর্থকেরা যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু একটি মিত্রের চেয়ে বড় কিছু বলে মনে করেন; সে জানানটাই তারা দিলেন।

জড়ো হওয়াদের একজন ৭৪ বছর বয়সী পিয়ং ইন-সু। তিনি বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার ‘দেশপ্রেমী নাগরিকদের’ বাধার কারণে পুলিশ ইউনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউনের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন বলেও তার বিশ্বাস।  পিয়ং ইন-সু’র হাতে থাকা দুই দেশের পতাকায় লেখা ছিল, “চলুন, একসঙ্গে এগিয়ে যাই।”

পতাকা ওড়াতে ওড়াতে পিয়ং ইন-সু বলেন, “আশা করি, আমাদের দেশকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে নিজের প্রভাব কাজে লাগাবেন ট্রাম্প।”

দক্ষিণ কোরিয়ায় নিজেদের বিরোধী পক্ষকে শত্রুদেশ উত্তর কোরিয়ার আজ্ঞবহ বলেই সন্দেহ করেন ইউনের সমর্থকেরা। তবে একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্দনা’ করতেও পিছপা হন না নিজেরা। তারা মনে করেন, জাপানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কোরিয়াকে স্বাধীন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত চলা কোরিয়া যুদ্ধেও দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষা করেছিল ওয়াশিংটন।

অবশ্য ইউনের অনুসারীদের এই সংখ্যা  তুলনামূলকভাবে অনেক কম; বরং প্রান্তিক বলা চলে।

৩ ডিসেম্বর সামরিক শাসন জারি করেছিলেন ইউন। দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাচনে জালিয়াতি করা হয়েছে এবং দেশটিতে ‘উত্তর কোরিয়াপন্থী এবং দেশবিরোধী শক্তির’ উপস্থিতি রয়েছে দাবি করে সামরিক শাসন জারির সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। ওই সিদ্ধান্তের জেরেই তাকে অভিশংসন করা হয়।

ইউনের নির্বাচনী জালিয়াতির দাবির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের আন্দোলনের মিল পাওয়া যায়।

দক্ষিণ কোরিয়ায় চলতি সপ্তাহে করা একটি জরিপে দেখা গেছে, ইউনের রক্ষণশীল পিপল পাওয়ার পার্টির ৬৫ শতাংশ সমর্থক মনে করেন, গত এপ্রিলে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে। যদিও সাধারণ মানুষের মাত্র ২৯ শতাংশ জালিয়াতি হয়েছে বলে মনে করে থাকেন।

এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ বিরোধী দলগুলো বড় জয় পেয়েছিল। পার্লামেন্টের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৯২টি আসনই জিতেছিল তারা। আদালত বা বড় কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক ওই নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। জালিয়াতির দাবিগুলোর সপক্ষে কোনো প্রমাণ না থাকায়, সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে ইউন সমর্থকদের এই তৎপরতার শুরুটা জানতে হলে ফিরতে হবে দেশটিতে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলোর উত্থানের সময়ে। কারণ এই চার্চগুলোই ইউনের সবচেয়ে উৎসাহী সমর্থকদের শক্ত ঘাঁটি।

এসব চার্চের বেশিরভাগ গড়ে তুলেছিলেন কোরিয়া যুদ্ধের আগে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা খ্রিষ্টানেরা। এ কারণে চার্চগুলোর মধ্যে কমিউনিস্ট বিরোধী কট্টর আদর্শ ঢুকে গিয়েছিল।

চার্চগুলোসহ প্রভাবশালী সারাং জেইল চার্চ মধ্য সিউলের গোয়াংহয়ামুন স্কয়ারে প্রায়ই সমাবেশের আয়োজন করত। সেখানে সব বিরোধীদের ‘কমিউনিস্ট’ তকমা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়ার কথা বলা হতো।

চার্চগুলোর সাপ্তাহিক সমাবেশ যুক্তরাষ্ট্রের দর্শকদের জন্য লাইভ এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করা হতো। আন্তর্জাতিক অনুদান পাওয়ার জন্য দেওয়া হতো ব্যাংক হিসাবের নম্বর।

ইউন সুক–ইওলকেও এই চার্চগুলোর সুরে সুর মেলাতে দেখা গেছে। ইউটিউবে তাদের সম্প্রচার করা ভিডিও দেখেন বলেও স্বীকার করেছেন তিনি।

খ্রিষ্টীয় নববর্ষের দিন নিজের সমর্থকদের সতর্ক করে ইউন বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে বিভিন্ন শক্তি। একই সঙ্গে এই শক্তির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন তিনি।

শুক্রবার প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান নেওয়া লোকজনের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে দুটি ভাষায় কিছু কথা লেখা ছিল। কোরীয় ভাষায় লেখা হয়েছিল- ‘নির্বাচনে জালিয়াতি’। আর ইংরেজিতে লেখা ছিল- ‘চুরি বন্ধ করুন।’

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads