বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ এনে তাকে ‘লক্ষ্যবস্তু বানানো’ এবং ‘ভিত্তিহীন’ প্রচারণার অভিযোগ করেছেন ব্রিটেনের সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক।
বিবিসির খবরে বলা হয়, টিউলিপের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদককে) একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।
যাতে বলা হয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগগুলো ‘মিথ্যা এবং হয়রানিমূলক’। সেগুলো গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরা হয়েছে অথচ, তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে তাকে কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
জানুয়ারিতে লেবার মন্ত্রিসভার ইকনোমিক সেক্রেটারি টু দি ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে সরে দাঁড়ান টিউলিপ সিদ্দিক।
ওই চিঠিতে, টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবী প্রতিষ্ঠান স্টিফেন হারউড সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, এই মামলায় কোনো যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি এবং অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
দ্য টাইমসের খবরে বলা হয়, টিউলিপের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এই দাবিগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ কখনোই ন্যায্য বা যথাযথভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, যা তথাকথিত তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
“বাংলাদেশ সরকারের কোনো আইনসিদ্ধ সংস্থার পক্ষ থেকে কখনোই তাকে স্বচ্ছ উপায়ে এই অভিযোগের মুখোমুখি করা হয়নি। এটি শুধুমাত্র তার সুনাম ক্ষুণ্ণ করা এবং যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য একটি রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ।”
দুর্নীতির অভিযোগের অসংগতি
বাংলাদেশ সরকারের একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, লন্ডনে তার একটি ফ্ল্যাট দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে কেনা হয়েছে, অথচ ওই সম্পত্তিটি তাকে ২০০৪ সালে আব্দুল মোতালিব উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন-যা তথাকথিত দুর্নীতির অনেক আগের ঘটনা।
অভিযোগ করা হয়েছে যে, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের জন্য দুর্নীতির অংশ হিসেবে ফ্ল্যাটটি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। তবে এটা অবাক করার মতো যে তাদের দাবি অনুসারে, ২০১৩ সালে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প স্বাক্ষরের এক দশক আগে এবং শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায়ও ছিলেন না (২০০৪ সালে) তখন এই সুবিধাটি হস্তান্তর করা হয়েছিল।”
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের উত্থাপিত ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ বলেও দাবি করেছেন সিদ্দিকের আইনজীবীরা। তাা প্রশ্ন রেখে বলেন, যেই সম্পত্তি বহু বছর আগে অর্জিত হয়েছে, তা কীভাবে পরবর্তী কোনো তথাকথিত দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে?
তার আইনজীবীরা বলছেন, “তিনি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কোনো আলোচনায় জড়িত ছিলেন না, বরং পারিবারিক সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো গিয়েছিলেন মাত্র। এই অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং স্পষ্টভাবে হয়রানিমূলক।”
ঢাকার কূটনৈতিক অঞ্চলে জমি নিয়ে বিতর্ক
আরও একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, সিদ্দিক তার প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার কূটনৈতিক জোনে অবৈধভাবে জমি অর্জন করেছেন।
কিন্তু টিউলিপ সরাসরি এই অভিযোগ নাকচ করে বলেছেন, তিনি কখনোই ঐ এলাকায় কোনো জমির মালিক ছিলেন না। বরং এটি তার বোনের কাছে একটি বৈধ সম্পত্তি হস্তান্তরের বিষয়, যা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য প্রসঙ্গে টেনে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের বিতর্কিত ভূমিকা
টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবী প্রতিষ্ঠান বলছে, দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগের পক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দিতে পারেনি। বরং সংস্থার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার-এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন।
সে সময় মোমেন বলেছিলেন, “স্টারমার যদি টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে স্থায়ীভাবে সম্পর্ক ছিন্ন না করেন, তবে এটি একজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা কমিয়ে দেবে।”
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এটিকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন টিউলিপের আইনজীবীরা। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কর্মকর্তা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের মান নিয়ে মন্তব্য করছেন। এটি শুধু টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে নয়, বরং যুক্তরাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপরও আঘাত।
বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কার্যকলাপ বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিশন কোনো যথাযথ তদন্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে শুধুমাত্র মিডিয়া ব্যবহার করে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে টিউলিপ সিদ্দিক ভবিষ্যতে আবার সরকারে ফিরে আসতে পারেন। তার সমর্থকদের মতে, এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের একটি দুর্বল প্রচেষ্টা, যেখানে একজন সম্মানিত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদকে অপদস্থ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
“এই বিতর্ক আরও তীব্র হয়ে উঠছে, এবং এখন সবার নজর থাকবে যুক্তরাজ্য সরকার কীভাবে এই সুস্পষ্ট বিদেশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জবাব দেয়,” বলেন টিউলিপের আইনজীবী।