নয় বছর আগে টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের এমপি হওয়ার পর বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। তাদের আশা ছিল, বঙ্গবন্ধু পরিবারের এই সদস্য একদিন মন্ত্রী হবে।
গত জুলাই মাসেই তাদের আশা পূরণ হয়ে যায়। টানা চতুর্থবার এমপি হয়ে লেবার পার্টির নতুন সরকারে স্থান পান ৪২ বছর বয়সী টিউলিপ। তাকে করা হয় ইকনোমিক সেক্রেটারি টু দি ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার; সহকারী মন্ত্রী হিসাবে দুর্নীতি দমনের দায়িত্বও তার ওপর বর্তায়।
টিউলিপ যখন যুক্তরাজ্য সরকারে স্থান পান, তখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছাত্রদের কোটা সংস্কারের আন্দোলন দানা বাঁধছে। সরকারের দমন-পীড়নের মুখে সেই আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তাতে পরের মাসের ৫ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে হয় শেখ হাসিনাকে।
দেড় দশক বাংলাদেশ শাসনের পর খালা শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি টিউলিপের জন্যও বিপত্তি ডেকে এনেছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির ঘটনায় তার নাম যেমন এসেছে, তেমনি যুক্তরাজ্যেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, আর এসবে জড়িয়ে আছে তার খালা শেখ হাসিনা কিংবা তার কোনও সহযোগীর নাম।
ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোতে একের পর এক সংবাদ ছাপা হচ্ছে টিউলিপের বিরুদ্ধে; সেখানে তার পরিচয় দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসকের ভাগ্নি হিসাবে। টিউলিপের পাশাপাশি তার ভাই-বোনের দুর্নীতির খবরও আসছে সংবাদপত্রগুলোতে।
দুর্নীতি দমন যার দায়িত্ব, তার দুর্নীতির খবরে টিউলিপের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন যুক্তরাজ্যের বিরোধী দলের সদস্যরা। টিউলিপ অবশ্য নিজেকে নিষ্কলুষ দাবি করছেন।
লেবার পার্টির প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার দলের এমপি টিউলিপের পক্ষে এখন পর্যন্ত থাকলেও কতদিন চাপ ঠেকাতে পারেন, সে দিকে তাকিয়ে আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের জন্ম ১৯৮২ সালে লন্ডনে। ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি হ্যাম্পস্টিড ও কিলবার্নে বসবাস করছেন। ওই এলাকায় স্কুলে পড়েছেন তিনি, কাউন্সিলরের দায়িত্বও পালন করেন।
কিংস কলেজ, লন্ডন থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্নমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া টিউলিপ লেবার পার্টিতে যোগ দিয়ে ২০১৫ সালে হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসন থেকে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। এরপর টানা দুটি নির্বাচনে ওই আসনে লেবারদের পতাকা উড়িয়ে রাখেন তিনি। গত বছরের জুলাইয়ের নির্বাচনে হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন তিনি। তারপরই সিটি মিনিস্টার করা হয় তাকে।
২০১৫ সালে প্রথমবার ভোটে জেতার পর টিউলিপ তার রাজনীতিক হওয়ার নেপথ্যে খালা শেখ হাসিনার অবদান স্মরণ করেছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমার খালা আমাকে সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছেন। তার কাছ থেকে রাজনীতি সম্পর্কে সবকিছু শিখেছি। সামাজিক ন্যায়বিচার, কীভাবে প্রচার চালাতে হয় এবং কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হয়, এসব শিখেছি।”
নয় বছর পর টিউলিপ যখন ওপরে উঠতে যাচ্ছেন, তখন সেই আত্মীয়তার সম্পর্কই পেছনে টানছে তাকে।
গত অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েকদিন আগে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রে খবর আসে, লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া ভাড়া নিজের আয়ের খাতে দেখাননি টিউলিপ।
সেই অভিযোগের তদন্তের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে অন্যের মালিকানায় থাকা একটি বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাসের অভিযোগও ওঠে।
২১ লাখ পাউন্ড দামের বাড়িটির মালিক আব্দুল করিম নামে বাংলাদেশি এক ধনকুবের। শেখ হাসিনা ওই ব্যবসায়ীকে বাংলাদেশে সিআইপি ঘোষণা করে ভিআইপির মর্যাদা দিয়েছিলেন, এমন তথ্যও তুলে ধরা হয় ডেইলি মেইলের খবরে।
এরপর রাশিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৪০০ কোটি পাউন্ড আত্মসাতে টিউলিপেরও জড়িত থাকার অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়লে তা নিয়ে লন্ডনেও শোরগোল ওঠে। যুক্তরাজ্যের পত্রিকাগুলোতে ২০১৩ সালে খালা শেখ হাসিনার সঙ্গে মস্কোতে যাওয়া এবং রূপপুর প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে রুশ প্রেসিডেনন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে টিউলিপের উপস্থিত থাকার ছবিও প্রকাশ করে।
এরপর টিউলিপের বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল লন্ডনে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মুফতে ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগ সামনে আসে। ওই ব্যবসায়ী আবার তার খালা শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট।
যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতে দুর্নীতি দমনের দায়িত্বপ্রাপ্ত টিউলিপ ২০০৪ সালে লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় দুই বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বুঝে নেন, তবে তার জন্য কোনও অর্থ পরিশোধ করেননি তিনি।
এরপর টিউলিপের ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীরও লন্ডনে বিনামূল্যে আরেকটি ফ্ল্যাট পাওয়ার খবর আসে সানডে টাইমসে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডের এমন একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন, যেটি তার পরিবারকে দিয়েছেন শেখ হাসিনার এক সমর্থক। ফ্ল্যাটটি আজমিনাকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল।
হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি ২০০৯ সালে আজমিনাকে হস্তান্তর করেন বাংলাদেশি আইনজীবী মঈন গণি। তার সঙ্গে শেখ হাসিনার ছবি থাকার কথাও জানায় সানডে টাইমস।
সর্বশেষ দুদিন আগে লন্ডনের টাইমস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, টিউলিপের বড় ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে প্রপাগান্ডা ছড়ানোয় যুক্ত ছিলেন।
এমন একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকায় টিউলিপ মন্ত্রী থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন বলে মনে করেন বিরোধী দলের নেতারা। তারা টিউলিপকে পদত্যাগ করার আহ্বানও জানাচ্ছেন।
টোরি দলের এমপি বব ব্ল্যাকম্যান সাংবাদিকদের বলেন, “এসব অভিযোগের বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের তার অবস্থান ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যদি তিনি তা না করেন, তবে মন্ত্রী থাকার যোগ্যতা তার আর থাকে না।”
টোরি দলের আরেক এমপি ও ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাট ভিকার বলেন, “সরকারের একজন সদস্যের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ একেবারে মানা যায় না, আর এটা আরও বড় হয়ে ওঠে, যখন দুর্নীতি প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠে।”
রূপপুর প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর টিউলিপকে যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জেরা করে বলে খবর আসে। তখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও টিউলিপের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, সিটি মিনিস্টারের প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে তার।
তবে আরও অভিযোগ আসার পর স্টারমারের ওপরও চাপ বাড়ে। সেই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যে সরকারের মন্ত্রীদের দায়িত্বশীল রাখার দায়িত্ব যার ওপর, সেই এথিকস অ্যাডভাইজর স্যার লাউরি ম্যাগনাস এ বিষয়ে তদন্ত করতে যাচ্ছেন বলে বিবিসি সোমবারই জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী স্টারমার বলেন, টিউলিপ নিজেই তার বিষয়ে তদন্তের জন্য ল্যাউরি ম্যাগনাসকে চিঠি দিয়েছেন।
টিউলিপ এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মন্তব্য করে স্টারমার বলেন, সহকর্মীর প্রতি তার যেমন আস্থা রয়েছে, তেমনি আস্থা রয়েছে তদন্ত প্রক্রিয়ার ওপরও।
টিউলিপ অবশ্য তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে অপপ্রচার চলছে। তাই তদন্তের মাধ্যমেই প্রমাণ হোক, আসলে তিনি মন্ত্রী পদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন কি না?
“গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাকে নিয়ে একের পর এক মিডিয়া রিপোর্ট হচ্ছে। সেখানে বেশিরভাগ তথ্যই সঠিক নয়। আমার পারিবারিক সম্পর্ক ধরেও লেখা হচ্ছে। আমি আমার কাছে স্পষ্ট, কোনো অনিয়ম আমি করিনি। তারপরও সংশয় ঘোচানোর জন্য আমি চাই আপনি তদন্তের মাধ্যমে সত্য কথাটি তুলে আনবেন।”
সরকারি প্রতিনিধি দলের হয়ে চীন সফরে যাওয়ার কথা ছিল টিউলিপের। তবে এই তদন্তের জন্য এখন তিনি চীন যাচ্ছেন না বলে সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।