ইউক্রেন কি টিকে থাকতে পারবে আরও একবছর?

যুদ্ধের ময়দানে দুই সেনা সদস্য। ছবি: ক্যানভা থেকে নেওয়া
যুদ্ধের ময়দানে দুই সেনা সদস্য। ছবি: ক্যানভা থেকে নেওয়া

যুদ্ধের ময়দান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে ইউক্রেনের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠলেও দোষ নেই যে টানা তিন বছরের যুদ্ধে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত সৈন্য নিয়ে দেশটি কি আরও এক বছর যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে?

ইউক্রেনের সেনারা পূর্বাঞ্চলে রুশ বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করলেও কুরাখোভ শহরের প্রায় চারপাশ ঘিরে ফেলা হয়েছে। যা সাম্প্রতিক সময়ে ওই এলাকাকে পরিণত করেছে ‘করুক্ষেত্রে’।

মর্টার ইউনিট ‘ব্ল্যাক প্যাক’ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও রুশ বাহিনী এগিয়ে আসছে তিন দিক থেকে।

সরেজমিনে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা বিশ্রামরত একদল সৈন্যকে দেখতে পায়, যারা প্রকৃতপক্ষে কেউই পেশাদার সৈনিক নন। এদের মধ্যে একজন পাচক, একজন মেকানিক, একজন ওয়েব ডেভেলপার এবং একজন শিল্পী রয়েছেন। বন্ধুদের এ দলটির সদস্যরা নিজেদের প্রথাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির এবং কেউ কেউ আবার ‘নৈরাজ্যবাদী’ বলে নিজেকে দাবি করলেন। তবে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন স্বেচ্ছায়।

দলটির কমান্ডার সুর্ত মাত্র ৩১ বছর বয়সী। রাশিয়ার পুরোদমে আক্রমণ শুরুর পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এই যুবক।

সুর্ত জানান, শুরুতে ভেবেছিলেন যুদ্ধ তিন বছর স্থায়ী হতে পারে। তবে এখন আরও ১০ বছর যুদ্ধ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়ে রাখলেন।

সবাই জানে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ট ট্রাম্প এই যুদ্ধের ইতি চান। ইউক্রেনের ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও আলোচনার জন্য প্রস্তুত থাকার ইঙ্গিত দিলেও কার্যকর চুক্তি কল্পনা করাও কঠিন বলে মনে হচ্ছে।

এখনও পর্যন্ত এটিকে কথার কথা বলে মনে হলেও ট্রাম্পের উদ্দেশ্যকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না সুর্ত।

ইউক্রেনের এই সৈন্য বলেন, “তিনি উচ্চকাঙ্ক্ষী এবং আমার ধারণা তিনি এটা করার চেষ্টা করবেন।” অবশ্য আলোচনা থেকে কোনো ফল পাওয়া নিয়ে তার মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

“আমরা বাস্তববাদী, আমরা বুঝি যে ইউক্রেন ন্যায়বিচার পাবে না। তাদের রকেট ও গোলার আঘাতে আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস এবং প্রিয়জন নিহত হয়েছে এই সত্যটা গিলে ফেলতে হবে, যা অনেকেরই জন্যই কঠিন হবে।”

যুদ্ধ নাকি আলোচনা? কী চায় জানতে চাইলে সুর্ত জোরকণ্ঠে বলেন, “চলুক যুদ্ধ।” দলটির অধিকাংশ একই ধারণা পোষণ করেন।

নিরামিষ পাচক সেরহির বিশ্বাস আলোচনা যুদ্ধটি শুধু সাময়িকভাবেই স্থগিত করবে,  “এবং এক বা দুই বছরের মধ্যে আবার সংঘাত ফিরে আসবে।”

ইউক্রেনের জন্য বর্তমান পরিস্থিতি ‘সুবিধার নয়’ স্বীকার করেন এবং যুদ্ধ জারি রাখতে প্রস্তুত বলে জানিয়ে এই পাচক বলেন, “মৃত্যু শুধুই পেশাগত একটি ঝুঁকি।”

সৈন্য দলটির আরেক সদস্য ডেভিড মনে করেন ট্রাম্পের ভাবনা উদ্বেগজনকভাবে অনিশ্চিত। তিনি ইউক্রেনের জন্য খুব ভাল আবার খুব খারাপও হতে পারেন।

দলটি এক সপ্তাহ যুদ্ধের ময়দানে থাকলে পরের সপ্তাহে বিশ্রামে থাকে। তবে বিশ্রামের সময় নিজেদের চাঙ্গা রাখতে প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখে।

হিমশীতল একটি মাঠে মর্টার গুলি ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ চলছে। দলটিতে সম্প্রতি যোগ দেওয়া ডেনিস জার্মানিতে তার নিরাপদ আশ্রয় স্বেচ্ছায় ছেড়ে এসেছে।

আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম- ইউক্রেনের অস্তিত্ব নেই এমন একটি পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারব কিনা? চেষ্টা না করলে হার অবধারিত। আমি অন্তত বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করে মরব, দর্শক হয়ে নয়। — সেনা সদস্য ডেনিস

তিনি বলেন, “আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম- ইউক্রেনের অস্তিত্ব নেই এমন একটি পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারব কিনা?”

যুদ্ধ হারার পথে রয়েছেন স্বীকার করতে বাধ্য হলেও ডেনিস বলেন, “চেষ্টা না করলে হার অবধারিত। আমি অন্তত বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করে মরব, দর্শক হয়ে নয়।”

তবে ডেনিসের ভাবনা অন্যদের থেকে ভিন্ন। তিনি মনে করেন ইউক্রেনের অন্তত একটা যুদ্ধবিরতির কথা ভাবা উচিত।

তার মতে, ইউক্রেনের প্রাণহানির সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি, চার লাখেরও বেশি হতাহত।

আরও লোককে সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করলেও সমস্যার সমাধান হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

“আমার শুধু মনে হয় অনেক সৈন্য হারিয়ে গেছে বা তারা খুবই পরিশ্রান্ত- আমরা কিছু সময়ের জন্য যুদ্ধ বিরতি চাই এমনটা নয়; তবে আমরা আরও অনেক বছর ধরে এভাবে চলতে পারব না,” বলেন ডেনিস।

ইউক্রেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর নিপ্রো। নিয়মিতভাবে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় ক্লান্তশহরটিতে মাঝে মাঝেই বিমান হামলার সাইরেন হাহাকার করে ওঠে। কখনও সেগুলো নীরব থাকলে অস্বাভাবিকতার মধ্যে কিছুটা স্বাভাবিকতা খুঁজতে থিয়েটারে যায় শহরের বাসিন্দারা।

হাস্যরসাত্মক নাটক ‘দ্য কাইদাশ ফ্যামিলি’ এর বিকেলের এক প্রদর্শনী, সেখানেও যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন ও পরে জাতীয় সংগীত গাওয়া হলো।

সেখানকার দর্শকদের মধ্যে অনেকে স্বীকার করেন যে তারা দীর্ঘস্থায়ী মুক্তি প্রত্যাশা করছেন।

লুদমাইলা নামে এক দর্শক বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সংখ্যা কমে গেছে। আমরা সহায়তা পেলেও তা যথেষ্ট নয় -আর এজন্যই আমাদের আলোচনায় বসতে হবে।”

এই দর্শকদের অনেকেই যুদ্ধের অবসান চান। মতামত জরিপগুলোতেও আলোচনা সমর্থনের হার বাড়ছে। তবে যুদ্ধবিরতির জোর আহ্বানগুলো আসছে যুদ্ধে বাস্তুহারাদের কাছ থেকে বেশি।

থিয়েটারের কাছে একটি আশ্রয় কেন্দ্রের বাসিন্দা আট বছরের ভ্যালেন্টিনা জানায়, তারা কিছু নিয়ে আসতে পারেনি। এখান থেকে তাদের জামা-জুতা এবং খাবার দেওয়া হয়েছে।

শিশুটি বলে,“অতিথি হওয়া ভালো। তবে বাড়িতে থাকা সবচেয়ে ভালো।”

যদিও ভ্যালেন্টিনার বাড়ি এখন রাশিয়ার দখলে। আশ্রয়কেন্দ্রে আরেক বাসিন্দা মারিয়া (৮৯) বলেন, “যা কিছু করেছে তারপর কেউই কি কারো চোখে চোখ রাখতে পারবে?

“এখন এটা স্পষ্ট যে কেউ জয়ী হবে না, আর এ জন্যই আমাদের আলোচনা প্রয়োজন।”

আর যদি সত্যিই আলোচনা হয় তবে এই নারীকেই সবচেয়ে বেশি কোরবানি দিতে হবে কেননা ইউক্রেনকে শান্তির বিনিময়ে ছাড় দিতে হতে পারে, বদলে যেতে পারে মানচিত্র।

বিবিসি অবলম্বনে মাহবুবা ডিনা

আরও পড়ুন