জাতিসংঘ মহাসচিবের দৌড়ে কারা আছেন?

নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের একটি জানালায় সংস্থাটির লোগো, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫। ছবি: রয়টার্স ভায়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের একটি জানালায় সংস্থাটির লোগো, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫। ছবি: রয়টার্স ভায়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ২০২৭ সালের ১ জানুয়ারি, আর এর জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা রয়েছে চলতি বছরের শেষের দিকে।

এরই মধ্যে সোশাল মিডিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কেউ কেউ প্রচারণা চালাতে শুরু করেছেন মুহাম্মদ ইউনূসও ওই প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন। যদিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত তথ্যের হদিস মেলেনি।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পদটি সাধারণত অঞ্চলের ভিত্তিতে ঘূর্ণায়মানভাবে দেওয়া হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে পূর্ব ইউরোপের পালায় পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও গুতেরেসকে নির্বাচিত করা হয়। সে হিসেবে এবারের পালায় লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ থেকে মহাসচিব বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অন্যান্য অঞ্চল থেকেও কেউ কেউ প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে থাকতে পারেন বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন।

রয়টার্স ছাড়াও ‘ওয়ান ফর এইট বিলিয়ন’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থাও সম্ভাব্য মহাসচিবদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের নাম পাওয়া যায়নি।

সংস্থাটি জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং পরবর্তী জাতিসংঘ নেতার কী ধরনের গুণাবলী ও অগ্রাধিকার থাকা উচিত তা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করে আসছে।

তাদের ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে: ‘ওয়ান ফর এইট বিলিয়ন’ প্রচারণার লক্ষ্য শুধুমাত্র প্রক্রিয়াটি নিয়ে কাজ করে; এটি কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে প্রকাশ্যে বা অন্যভাবে অবস্থান নেয় না।

২০২৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিক ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাচেলেটকে জাতিসংঘের মহাসচিব পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেবেন। লাতিন আমেরিকার দেশ হিসেবে সেক্ষেত্রে মিশেল ব্যাচেলেট হতে পারেন শক্তিশালী প্রার্থী।

মিশেল ব্যাচেলেট। ছবি: ইউএন।

চিলির সাবেক রাষ্ট্রপতি মিশেল ব্যাচেলেট জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দায়িত্ব সামলেছেন।

এছাড়া আর্জেন্টিনার নাগরিক রাফায়েল গ্রোসি একাধিকবার জাতিসংঘের মহাসচিব পদে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো ২০২৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও তিনি প্রার্থী হিসেবে লড়বেন বলে জানিয়েছিলেন।

রাফায়েল গ্রোসি। ছবি: ইউএন।

পুরো নাম রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি, যিনি একজন পুরোদস্তুর আর্জেন্টাইন কূটনীতিক। তিনি ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

এর আগে তিনি অস্ট্রিয়ায় আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং একই সঙ্গে স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া ও ভিয়েনাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছেও আর্জেন্টিনার প্রতিনিধি হিসেবে সমধিক পরিচিত।

অন্যদিকে, কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো চাভেস ৮ অক্টোবর এক ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি দেশটির সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতিকে জাতিসংঘের মহাসচিব পদে প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনীত করবেন।

কোস্টারিকার সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি রেবেকা গ্রিনস্প্যান। ছবি: ইউএন।

রেবেকা গ্রিনস্প্যান জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিটিএড) মহাসচিব এবং কোস্টারিকার সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি।

এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মহাসচিব পদে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বেশ কিছু নাম এসেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের মধ্যে রয়েছেন নিউ জিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন, ম্যাক্সিকোর পররাষ্ট্র সচিব অ্যালিসিয়া বারসেনা, বলিভিয়ার উপ-রাষ্ট্রপতি ডেভিড চোকেউয়ানকা, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাবেক সভাপতি একুয়েডরের মারিয়া ফার্নান্দা এসপিনোসা গার্সেস, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বুলগেরিয়ার ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা।

জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রার্থী দৌড়ে রয়েছেন নিউ জিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নসহ বাকিরাও।

সার্বিয়ার সাধারণ পরিষদের সাবেক সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুক জেরেমিচ, নাইজেরিয়া ও যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিক জাতিসংঘের উপ-মহাসচিব আমিনা মোহাম্মদ, বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মটলি, ব্রাজিল ও জার্মানির দ্বৈত নাগরিক জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির প্রশাসক আখিম স্টেইনারের নামও শোনা যাচ্ছে।

প্রার্থী বাছাই শুরু কবে?

এই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে তখনই যখন ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা কাউন্সিল এবং ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদের সভাপতি যৌথ চিঠি পাঠাবে, যার মাধ্যমে মনোনয়নের জন্য আহ্বান জানানো হবে।

সাধারণত বছরের শেষের মধ্যে ওই চিঠি পাঠানোর কথা। আর এক্ষেত্রে একজন প্রার্থীকে জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র দ্বারা মনোনীত হতে হবে।

প্রক্রিয়াটি কীভাবে হয়?

১৫ সদস্যের নিরাপত্তা কাউন্সিল আনুষ্ঠানিকভাবে একজন প্রার্থীকে ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদে নির্বাচন করার জন্য সুপারিশ করবে, যার মাধ্যমে ১০ম জাতিসংঘ মহাসচিব নির্বাচিত হবেন।

এক্ষেত্রে নিরাপত্তা কাউন্সিল গোপন ভোট গ্রহণ করবে, যাকে ‘স্ট্র পোল’ বলা হয়। ‘স্ট্র পোলের’ সময় প্রতি প্রার্থীর জন্য কাউন্সিলের সদস্যরা তিনটি বিকল্পের মধ্যে ভোট দিতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে- উৎসাহিত করা (encourage), নিরুৎসাহিত করা (discourage) এবং কোনো মতামত নেই (no opinion)।

চূড়ান্তভাবে, পাঁচটি স্থায়ী ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্য- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন এবং ফ্রান্সকে প্রার্থীর বিষয়ে একমত হতে হয়।

‘স্ট্র পোলের’ সময় ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্যদের ব্যালট সাধারণ নির্বাচিত দশজন সদস্যের ব্যালটের থেকে আলাদা রঙের হয়ে থাকে।

২০১৬ সালে গুতেরেসকে সাধারণ পরিষদে সুপারিশ করার জন্য নিরাপত্তা কাউন্সিলকে ছয়টি ‘স্ট্র পোল’ করতে হয়েছিল।

এরপর নিরাপত্তা কাউন্সিলে একটি প্রস্তাবনাপত্র গৃহীত হয়, যা সাধারণত বন্ধ দরজার পেছনে হয়, এবং সাধারণ পরিষদে একটি মনোনয়নের সুপারিশ করা হয়।

প্রস্তাবনাটি পাস করার জন্য ন্যূনতম নয়টি ভোটের সমর্থন প্রয়োজন এবং কোনো ভেটো থাকলে তা কার্যকর হয় না।

প্রক্রিয়াটি কতটা স্বচ্ছ?

জাতিসংঘ ঐতিহাসিকভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে কাজ করে আসছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে গৃহীত একটি প্রস্তাবে সাধারণ পরিষদ বলেছে যে, প্রতিটি প্রার্থীকে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনীত হওয়ার সময় একটি বিবৃতি দিতে হবে, যা জাতিসংঘের একটি ওয়েবসাইটেও প্রচার করা হবে।

পরিষদ বলেছে যে, প্রতিটি প্রার্থীকে তাদের তহবিলের উৎস প্রকাশ করতে হবে এবং কোনও প্রার্থী যারা জাতিসংঘের পদে অধিষ্ঠিত আছেন তাদের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে, যাতে তাদের কাজের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়ানো যায়।

মহাসচিব কী করেন?

জাতিসংঘ সনদে মহাসচিবকে বিশ্বের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে ভূমিকা ‘কূটনীতিক এবং আইনজীবী, বেসামরিক কর্মচারী এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা’ হিসেবে উদ্ধৃত রয়েছে।

বর্তমানে ৩০ হাজারের বেশি বেসামরিক কর্মী এবং প্রায় ৬০ হাজার সেনা ও পুলিশ নিয়ে পরিচালিত ১১টি শান্তিরক্ষা অভিযানের তত্ত্বাবধান করছেন গুতেরেস।

জাতিসংঘের মূল বার্ষিক বাজেট ৩.৭ বিলিয়ন ডলার, আর শান্তিরক্ষা বাজেট ৫.৬ বিলিয়ন ডলার।

যেহেতু সামরিক শক্তি বা নিষেধাজ্ঞা অনুমোদনের ক্ষমতা নিরাপত্তা কাউন্সিলের হাতে, মহাসচিবের বাস্তব ক্ষমতা খুব বেশি নয়। অনেক কূটনীতিকের মতে, পাঁচ স্থায়ী ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্যরা মহাসচিবকে “জেনারেল” হিসেবে নয়, বরং “সচিব” হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন।

নারী মহাসচিব হয়েছেন কি?

জাতিসংঘের ৮০ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী মহাসচিব নির্বাচনের দাবী ক্রমেই বাড়ছে। সেপ্টেম্বরে গৃহীত প্রস্তাবনায় সাধারণ পরিষদ “দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে যে, এখনও পর্যন্ত কোনো নারী মহাসচিব হননি” এবং দেশগুলোকে “নারীদের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করার বিষয়ে দৃঢ়ভাবে বিবেচনা করতে” উৎসাহিত করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ওয়ান ফর এইট বিলিয়ন

আরও পড়ুন