একজন কূটনীতিক যখন বিদেশে থেকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন, তখন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফর তার জবাব হিসাবে কাজ করবে বলে আশা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন শনিবার জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসে বললেন, “জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশবিরোধী ভুয়া তথ্য প্রচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার এই সফর যে কোনো ধরনের মিথ্যা প্রচার ও অস্থিতিশীল করার চেষ্টাকে প্রতিহত করবে।”
তার এই বক্তব্যের সুর অনকেটাই এক বছর আগেকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের মতো। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যখনব সমালোচিত, তখন হাছান মাহমুদ বিভিন্ন দেশের সরকারের অভিনন্দন বার্তার সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের শুভেচ্ছা বার্তা আসার খবর দিয়ে বোঝাতে চাইছিলেন, দেশে যত সমালোচনাই হোক না কেন, বিশ্ব সম্প্রদায় শেখ হাসিনার সঙ্গে।
দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা গত বছরের ওই নির্বাচনের আট মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার এক অভ্যুত্থানে উৎখাত হয়ে এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে আছেন।
তারপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে তার নেতৃত্ব নেন নোবেলজয়ী ইউনূস। তার আমন্ত্রণেই চার দিনের সফরে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস।
তার এই সফরে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের ওপর আলো ফেলবে বলে আশা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ঘুরে এসেছেন, সেখানে কথাও বলেছেন।
কিন্তু ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সফরে সময় গুতেরেস যা বলেছিলেন, এবারও তার বাইরে তেমন কোনো কথা পাওয়া যায়নি তার কাছে। সঙ্কট আরও গভীর হয়েছে, তাতে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিই কেবল এসেছে আগের মতো করেই।
সরকার-সংস্কার নিয়ে কী বার্তা?
জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে থাকার মধ্যেই শুক্রবার ইউনূসের তীব্র সমালোচনা করে ‘বাংলাদেশকে বাঁচাতে বিশ্ব নেতাদের এগিয়ে আসার’ আহ্বান জানিয়ে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দেন মরক্কোতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হারুন আল রশিদ।
অন্তর্বর্তী সরকার তাকে দেশে ফিরতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ পাওয়া হারুন দেশে না ফিরে মরক্কো থেকে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। সেখান থেকেই ফেইসবুকে তিনি লিখেছেন, জঙ্গিদের মদদ দিয়ে বাংলাদেশ ধ্বংস করে দিচ্ছেন ইউনূস।
তা নিয়ে আলোচনার মধ্যে শনিবার ঢাকায় জাতিসংঘ মহাসচিবকে পাশে রেখে সংবাদ সম্মেলনে আসেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ। তিনি গুতেরেসের সফরকে ঐতিহাসিক অভিহিত করে বলেন, “জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সফল করতে সাহায্য করবে।”
অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ও প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক সংস্কারে হাত দিয়েছে। নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারই তাদের অগ্রাধিকার।
এই সংস্কার নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি জনগণের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রত্যাশাকে স্বীকার করি।”
সংস্কারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ প্রধান সহযোগী হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত করতে চাই যে শান্তি বজায় রাখতে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের এক নম্বর সহযোগী হিসেবে গণ্য করতে পারেন আপনারা।”
দেখে আসা যাক, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে জাতিসংঘ মহাসচিব কী বলতেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রায় প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সময় গুতেরেসের সঙ্গেও দেখা করে আসতেন। ২০১৮ সালে গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে এলেও তাদের বৈঠক হয়।

ওই সব বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্যই আসত। ২০২৪ সালে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় বসার পর শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন গুতেরেস; শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণের প্রশংসায় ভরা ছিল এই সেই বার্তা।
গুতেরেস বলেছিলেন, “আমি গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপে আপনার অংশগ্রহণের প্রশংসা করছি এবং বিশ্বাস করি যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক কাঠামোর সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনসহ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমি আপনার সমর্থনের ওপর নির্ভর করা অব্যাহত রাখতে পারি।”
ওই বছরের জানুয়ারিতে উগান্ডায় তৃতীয় দক্ষিণ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ দেখা করেছিলেন গুতেরেসের সঙ্গে। সেই বৈঠক নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, “জাতিসংঘ মহাসচিব বৈশ্বিক অর্থনীতির কাঠামো সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। জাতিসংঘের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক প্রক্রিয়ায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যও তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন।”
২০১৮ সালে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার পর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল শেখ হাসিনার।
সেই বৈঠকের পর তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেছিলেন, “শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সব ধরনের সহযোগিতার কথা বলেছন জাতিসংঘ মহাসচিব।”
তার ভাষ্য অনুযায়ী, গুতেরেস তখন এটাও বলেছিলেন যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন অন্য সবার জন্য শিক্ষণীয়।
তারপর শেখ হাসিনার সঙ্গে গুতেরেসের বিভিন্ন বৈঠকের পর এমন বার্তাই এসেছিল।
ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে গণহত্যার মামলায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে কোনো সহায়তা চাওয়া হয়নি বলে জানান তৌহিদ হোসেন।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে কী বার্তা?
২০১৮ সালে বাংলাদেশ সফরের সময়ও শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গুতেরেস।
তিনি বলেছিলেন, “আমরা মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছি। আমাদের এই চাপ আরও বাড়াতে হবে যাতে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে কী করা উচিৎ- তা মিয়ানমার বুঝতে পারে।”
এরপর ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে দুজনের বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে প্রশংসায় ভাসিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার মানবিক আচরণ অন্য অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।
নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেও তা বাংলাদেশের জন্য ভার হয়ে পড়েছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার চুক্তিবদ্ধ হলেও আট বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ দেন-দরবার চালিয়ে গেলেও কোনো ফল আসেনি।
জাতিসংঘ মহাসচিবের এবারের সফরের মূল উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের প্রতি তার সমর্থন ও সহমর্মিতা জানানো। সেই সঙ্গে ইউনূস সরকারের লক্ষ্য ছিল মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর বন্দোবস্ত করা।

শুক্রবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখার পর গুতেরেস বলেন যে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হচ্ছে এই জনগোষ্ঠীর মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন।
ফলে এর সমাধানের চাবিকাঠি মিয়ানমারের হাতেই। কিন্তু মিয়ানমারকে কীভাবে মানানো যায়, তার কোনো দিক-নির্দেশনা তিনি দিতে পারেননি। দেশটির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গও তিনি এড়িয়ে গেছেন।
বরং মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ চলার দিকটি দেখিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি হলো, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে এবং সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত কঠিন হবে, তা স্পষ্ট।”
পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গুতেরেস জাতিসংঘ মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়ার আগে ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ছিলেন। সেই পদে থেকেও বাংলাদেশ সফর করেছিলেন তিনি। এরপর জাতিসংঘ মহাসচিব হয়ে দুবার সফর করলেন।
মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করার সম্ভাব্যতার কথা বলেন তিনি।
তার ভাষ্যে, “মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই, যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।”
মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা পৌঁছতে করিডোর চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ রাজি কি না, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ সেবিষয়ে সরাসরি কিছু বলেননি।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে শুক্রবার কক্সবাজার গিয়ে রোহিঙ্গাদের আশার বাণী শুনিয়েছিলেন প্রধা্ন উপদেষ্টা ইউনূস। তিনি বলেছিলেন, তার আশা আগামী বছরের ঈদ যেন রোহিঙ্গারা তাদের দেশে করতে পারে।
তবে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদের কথায় অতটা আশার সুর ফোটেনি।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান কী- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “সমাধানটি সীমান্তের অন্য পাড়ে। ওখানে সবগুলো কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। কারণ মিয়ানমারে এখন ভিন্ন একটি বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তাই আমাদের সব পক্ষকেই রাজি করাতে হবে, যাতে রোহিঙ্গার নিশ্চিন্তে রাখাইনে ফিরে যেতে পারে।”
অর্থাৎ, আগে শুধু মিয়ানমার সরকারকে রাজি করাতে পারলেই চলত, এখন সরকারকে রাজি করাতে পারলেও চলবে না, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকেও রাজি করাতে হবে।
এ সম্পর্কিত খবর:
‘শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়নি’