জুলাই অভ্যুত্থানের পর ‘নতুন বাংলাদেশে’ কত কিছু যে বদলেছে, তার কোনো ইয়াত্তা নেই। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম তো সব স্থান থেকে মুছে গেছেই, দেশের সাংবিধানিক নাম পাল্টে দেওয়ার তোড়জোড়ও চলছে।
এরমধ্যেই সপ্তাহের মঙ্গলবার নামটি বদলে দেওয়ার আওয়াজ উঠেছে সোশাল মিডিয়ায়। আর তা শুরু হয়েছে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা অনুষদের এক ঘোষণার পর।
পহেলা বৈশাখে তিন যুগ ধরে হয়ে আসা মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা কিনা ইউনেস্কোর বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গৌরবে অধিষ্ঠিত, তার নাম পরিবর্তন করে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ করার পর থেকেই এই সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করে মঙ্গলবারেরও নাম বদলের আওয়াজ উঠেছে।
চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী, দীর্ঘদিন মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনে সম্পৃক্ত থাকা সালেহ মাহমুদ ফেইসবুকে লিখেছেন, “মঙ্গল শোভাযাত্রার মঙ্গল শব্দটায় যাদের এলার্জি আছে, তাদের বলছি, সংস্কার যদি করতেই হয় তবে গোড়া থেকেই করুন, প্রতি সপ্তাহে মঙ্গল বলে যে বারটা আছে, আগে সে বারের নামটি বদলে দিন। সমূলে উৎপাটন করুন।
“তবে এতেও সমাধান হবে বলে মনে হয় না। মঙ্গলের বীজ আকাশে বাতাসে ভাসছে, জল, কাদামাটি পেলে আবার জন্মাবে।”
মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটির মধ্যে ‘হিন্দুয়ানি’ গন্ধ আছে দাবি করে এই নামটি পরিবর্তনের দাবি তুলেছিল হেফাজতে ইসলাম। তারা এক সময় চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়েই আপত্তি করত। তবে এবার তারা ‘মঙ্গল’ নামটি বদলে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ করলেই তাতে অনাপত্তির কথা জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে তাদের সেই দাবিই পূরণ হলো।
বিবিসি বাংলার সাংবাদিক সায়েদুল ইসলাম তালাত এনিয়ে এক পোস্টে লিখেছেন, “মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলের পর আমার অনুরোধ, মঙ্গলবারের নাম বদলে আনন্দবার করা হোক।
“সেই সাথে ‘রামছাগল’ নামটাও পরিবর্তন করা হোক। বিশেষ করে যার নামের সাথে ‘রাম’ শব্দটা আছে, সেটা মুসলমানদের খাওয়া উচিৎ কি না? আর হ্যাঁ, ‘ওল্ড রাম’ এর নামটাও বদলাতে হবে।”

মঙ্গলবারের নাম পরিবর্তন চেয়ে এমন পোস্ট অনেকেই দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। এসব পোস্ট দেখে কেউ কেউ আবার লিখছেন, শুধু মঙ্গলবারের নাম বদলেই হবে না, সপ্তাহের সব বারের নামই তো হিন্দু সংশ্লিষ্ট।
একজন কটাক্ষ করে লিখেছেন- “মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের কারণে অনেকে মঙ্গলবারের নাম পরিবর্তন করার কথা বলেছেন। একদম হক কথা। কিন্তু মুসিবত আরো আছে।
শনি- হিন্দুদের দেবতা, মৃত্যু, অনিষ্টের প্রতীক।
রবি- সূর্যদেব, বড় কথা রাবীন্দ্রিক কালচারাল ফ্যাসিজম যুক্ত।
সোম- বিধু, চাঁদ; হিন্দুদের দেবতা।
মঙ্গল- শুভ, কল্যাণ।
বুধ- চন্দ্রের পুত্র, হিন্দুদের দেবতা।
বৃহস্পতি- অঙ্গিরার পুত্র, দেবতা।
শুক্র- দেবতা, অসুর বা দৈত্যদের গুরু।
কাজ যেটা করা যেত, সবকয়টা উর্দুতে করে দেওয়া। কিন্তু উর্দুতেও মঙ্গলবারের নাম মঙ্গলবার দেখে দিলটা ভারী হয়ে উঠলো।”

নাম পরিবর্তন নিয়ে এসব কটাক্ষমূলক মন্তব্যের পাশাপাশি তার পক্ষেও বলছেন অনেকে।
প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “শোভাযাত্রা কি ঈশ্বর প্রেরিত কোনো বার্তা যার নাম পরিবর্তন করা যাইবে না? এত কষ্ট এত ইগো কই রাখেন? যশোরে যেটা শুরু হইলো ‘বর্ষবরণ শোভাযাত্রা’ নামে, ওইটারে ঢাকায় আইন্ন্যা বানাইলেন আনন্দ শোভাযাত্রা। তারপরে কিছু সাংস্কৃতিক মোড়ল ওইটারে বানাইলো মঙ্গল শোভাযাত্রা।
“তা ওই চেঞ্জগুলা কেন করছিলেন? এখন তাহলে চেঞ্জড হয়ে আগের নামে ফিরে যেতে পারবে না কেন? এইডা কি কেউ দিলের ভিতরে খোদাই কইরা লিখা দিছে যে ‘নাম পরিবর্তন যোগ্য নহে।”
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, “শেখ হাসিনা আর ফ্যাসিস্ট এখন সমার্থক। হাসিনা তার কাল্ট পার্সোনালিটি ইন্টেনসিফাই করতে কালচারাল ফ্রন্টকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছে, কখনো অস্ত্র হিসেবেও। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ কাল্ট গডেস হাসিনা ও তার শাসনকে ধ্বংস করেছে।”
এটা ঠিক যে ১৯৮৫ সালে যশোরে চারুপীঠ নামের একটি সংগঠনের আয়োজনে পহেলা বৈশাখে যে বৈশাখী শোভাযাত্রা বের হয়েছিল, তা থেকে উৎসাহ নিয়েই ১৯৮৯ সালে ঢাকায় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা; তবে তখন এই শোভাযাত্রা ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক সংগ্রামের চেতনা থেকে।
শিল্পী সালেহ মাহমুদ লিখেছেন, “শামীম ভাই (মাহবুব জামিল শামীম) যশোরে প্রথম বর্ষবরণ শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিলেন একথা ঠিক, কিন্তু দেশজুড়ে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সবার উৎসবে পরিণত করার পেছনে উনার বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই।

“বৈশাখ উৎসব বা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সবার উৎসবে পরিণত করার পেছনে কিংবা দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে যাদের ভূমিকা রয়েছে, তারা তাদের এ ভূমিকাকে তাদের স্বপ্ন বলে বলে বেড়ায় না (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) বরং তারা এর কৃতিত্ব দিয়েছে একটা প্রতিষ্ঠানকে। চারুকলাকে।”
১৯৮৯ সালে (১৩৯৬ বঙ্গাব্দ) চারুকলা থেকে প্রথম যে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল, তার নাম ছিল- ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। তবে তখন মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম করার ইচ্ছা থাকলেও রাজনৈতিক কারণে তা করা হয়নি বলে জানান তখন থেকে বৈশাখের এই আয়োজনে যুক্ত থাকা চারুকলার অধ্যাপক নিসার হোসেন।
সেই শোভাযাত্রার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি অনলাইন পোর্টাল সকাল সন্ধ্যাকে গত বছর বলেছিলেন, “তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছিল। তার বিপরীতে সব ধর্মের মানুষের জন্য বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারাই মূলত এই আয়োজনটি করেছিল। এই শোভাযাত্রা তখন থেকেই স্বৈরাচারবিরোধী এবং মৌলবাদবিরোধী।”

ধীমান ওয়াহিদুল হক, শিল্পী ইমদাদ হোসেন, রফিকুন নবী ষাটের দশকে বাঙালির আত্ম পরিচয়ের শেকড় সন্ধানে ছায়ানটের যে বৈশাখী আয়োজন, তারই ধারায় মঙ্গল শোভাযাত্রাকেও একটি রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা নামটিও ওয়াহিদুল হকেরই দেওয়া।
আনন্দ শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হলেও এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকারের পতনের পর তা মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেই প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে বের হতে থাকে। ২০১৬ সালে তা জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেসকোর বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেই।
প্রথমবার নামকরণ আনন্দ শোভাযাত্রা কেন ছিল- প্রশ্নে তখনকার তরুণ শিক্ষক নিসার বলেন, নামটা মঙ্গল শোভাযাত্রাই দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাদের। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে এর ভুল ব্যখ্যা হতে পারে, এই আশঙ্কায় আনুষ্ঠানিকভাবে নামটি তখন উহ্য রাখা হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান শুক্রবার চারুকলায় এবারের শোভাযাত্রার আয়োজনের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তারা শোভাযাত্রার আদি নামেই ফিরে যাচ্ছেন। সেই কারণে ১৪৩২ বঙ্গাব্দ বরণে শোভাযাত্রার নাম হচ্ছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
তিনি আরও বলেন, “এই শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্যে দুটো মেসেজ আছে। একটি হচ্ছে, একটি নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান। রাজনৈতিক ও সামাজিক নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। কিছু মোটিফ সেই কাজটি করছে। আর দ্বিতীয় যে অংশটি আছে, সেটি হচ্ছে মূলত ঐক্যের ডাক, সম্প্রীতির ডাক।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সিদ্ধান্তের আগে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্ট মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম বদলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
তার আগে হেফাজতে ইসলামের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, “পহেলা বৈশাখ উদযাপনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মাচারকে তথাকথিত ‘সর্বজনীনতার’র নামে সবার ওপর চাপিয়ে দেয় ফ্যাসিবাদী সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। সেক্যুলারদের বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের বিভিন্ন দেবতা ও ধর্মীয় পশু-পাখির মূর্তি ও প্রতিকৃতিতে সয়লাব থাকে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগকে ‘সেক্যুলার ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর’ আখ্যািয়ত করে হেফাজত নেতারা শোভাযাত্রা থেকে ‘মঙ্গল’ শব্দ বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, “প্রাথমিক সমাধান হিসাবে মঙ্গল শব্দ পরিবর্তন করে পহেলা বৈশাখের আদি ও আসল আনন্দ শোভাযাত্রা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখতে পারে সরকার।”
দৃশ্যত তাদের দাবি মেনে শুক্রবার সিদ্ধান্ত আসার পর প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে মতামমত বিভাগে লিখেছেন লেখক-উন্নয়নকর্মী চিররঞ্জন সরকার, যার শিরোনাম দিয়েছেন- ‘চারুকলার শোভাযাত্রা: আনন্দে ঝরে গেল মঙ্গল!’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী লিখেছেন, “কিন্তু কে জানে, কালকেই হয়তো কেউ দাবি করে বসবেন— ‘আনন্দ’ শব্দটিও খুবই সন্দেহজনক! তখন হয়তো নাম হবে— ‘বর্ষবরণ উল্লাস পদযাত্রা’। আর যদি সেখানেও সমস্যা থাকে, তাহলে শেষ বিকল্পটি খোলা আছে: ‘বর্ষবরণ শব্দহীন নীরবতা’।
শিল্পী সালেহ মাহমুদ লিখেছেন, “মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে, স্বৈরাচারী এক সরকারের আমলে। একটা অশুভ রাষ্টশক্তির বিপরীতে মানুষকে নিজস্ব ঐতিহ্যের বন্ধনে একত্রিত করা মঙ্গল শোভাযাত্রার একটা মূখ্য লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কখনই কোনো রাজনৈতিক দল বা দলীয় ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে এর অবস্থান বা উপস্থাপনা ছিল না।
“লোকজ মোটিফের বাইরে কখনও কখনও প্রাসঙ্গিকভাবেই অশুভ শক্তির দানবীয় চরিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির নয়। একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ, অশুভ শক্তি। ওটাকে আপত্তিকর বলে অনেকেই এখন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে সাফাই গাইছে, এটা দুরভিসন্ধিমূলক, ভয়ঙ্কর। আবার একজন উপদেষ্টা বেগম খালেদা জিয়ার অন্য মিছিলের ছবিকে মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি বলে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এসব অজ্ঞতা নয়, দুরভিসন্ধি, যা জাতির জন্য কখনই মঙ্গলজনক নয়।
“ফ্যাসিবাদের নাম ভাঙিয়ে যে প্রতিহিংসা ও ঘৃণার চাষাবাদ চলছে, তা জাতিকে শুধু বিভাজিত নয় খণ্ড বিখণ্ড করে ছাড়বে। আজ যারা নানা কথা বলে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ফ্যাসিবাদী চরিত্র দান করতে চাচ্ছে, তারা নিজেরাই নয়া ফ্যাসিবাদের ধারক কি না, সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।”
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
‘চারুকলা’র বৈশাখের আয়োজনে না থাকার ঘোষণা আয়োজক ব্যাচের