শুরুটা হয়েছিল ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধনমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি ভাঙার মধ্য দিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি, বুধবার। বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইনে উসকানি এবং ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্পৃহতায়’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পরবর্তীতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন জেলায় ও শহরে।
কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের স্থাপনা ও নেতানেত্রীর বাসভবনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়েছে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মীরাও।
শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বুধ থেকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে, ভেঙে ফেলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, আক্রান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি ও দলীয় অফিসও।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস ও তার পরিষদের সদস্যদের এর জন্য দায়ী করেছেন; বলেছেন, এর বিচার জনগণই করবে।
এদিকে, টানা দুই দিন ভাঙচুরের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের চেষ্টা শক্তভাবে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১টা ১ মিনিটে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে যে কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সারা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করছে। সরকার এ ধরনের কর্মকাণ্ড শক্তভাবে প্রতিহত করবে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রস্তুত। কোনো ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেবে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।’
ঢাকার বাইরে শেখ হাসিনার চাচার বাড়ি ‘শেখ বাড়ি’ ভাঙার মধ্য দিয়ে ভাঙচুরের সূত্রপাত করে কথিত শিক্ষার্থীরা। বিস্তারিত বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো খবর:
খুলনা
খুলনা নগরের ময়লাপোতা এলাকায় অবস্থিত ‘শেখ বাড়ি’র একটি অংশ এক্সকাভেটর দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার রাত নয়টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ঘোষণা দিয়ে ওই ভাঙচুর শুরু করেন। রাতভর দুটি এক্সকাভেটর চালিয়ে বাড়ির প্রধান ফটক, দেয়ালসহ বেশির ভাগ অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাড়িটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ আবু নাসেরের। এ বাড়িতে শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন, বিসিবির সাবেক পরিচালক ও কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা শেখ সোহেল উদ্দিনসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা বসবাস করতেন। মূলত ওই বাড়ি থেকেই পদ্মার এপারের আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো।
রাতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটকের সামনে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালটিও এক্সকাভেটর দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে খুলনার সরকারি ব্রজলাল কলেজে (বিএল) শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল।
কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়ায় এক্সকাভেটর দিয়ে ভাঙা হয়েছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়ির একটি অংশ। মুছে ফেলা হয়েছে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হল থেকে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও যুবলীগ নেতা সেলিম আলতাফের (জর্জ) ব্যক্তিগত কার্যালয়ে দুই দফায় ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। কুষ্টিয়া শহরের মজমপুরে সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব বাদশার বাড়িতেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও গ্লাস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
চুয়াডাঙ্গা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘এক্সকাভেটর মিছিল’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরে শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের চারটি ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
যশোর
যশোরে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার সাতটি ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও নামফলক ভাঙচুর করা হয়েছে। কেশবপুরে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এ এস এস কে সাদেকের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে।
বরিশাল
বরিশালে বুলডোজার দিয়ে সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ এবং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর বাড়ি ভাঙা হয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর ফলকে শেখ হাসিনার নাম থাকায় সেটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
ভোলা
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ভোলা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের বাসভবনে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি লুট করা হয়েছে বাড়িতে থাকা আসবাব ছাড়াও মূল্যবান জিনিসপত্র।
পিরোজপুর
পিরোজপুরে সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আউয়াল এবং তাঁর ভাই সাবেক মেয়র হাবিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ লোকজন।
সিলেট
সিলেটে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাঙচুর হওয়া ম্যুরালটি এক্সকাভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচটি ম্যুরাল এবং শহরের একটি পাড়ায় থাকা একটি মাজারে ভাঙচুর হয়েছে। পরে শহরের ঐতিহ্য জাদুঘর প্রাঙ্গণে থাকা শেখ মুজিবর রহমানের আরেকটি ম্যুরালও ভাঙচুর করা হয়। একে একে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জেলা পরিষদ ও সদর উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে থাকা ম্যুরালগুলো ভেঙে ফেলা হয়। গভীর রাতে পৌর শহরের হাছননগর এলাকায় হুসেন বখত চত্বরের দক্ষিণ পাশে থাকা ‘ডংকা শাহের মাজার’ হিসেবে পরিচিত আধা পাকা ছোট ঘরটিও ভেঙে ফেলা হয়।
রংপুর
রংপুরে গতকাল রাতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কারমাইকেল কলেজে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের নামফলক।
রাজশাহী
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের গ্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সব নামফলক, গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন মুছে দিতে বিক্ষোভ করা হয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নওশাদ আলীর বাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়েছে।
নাটোর
নাটোর শহরে সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলামের (শিমুল) জান্নাতি প্যালেসে আবার আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
পাবনা
পাবনার ঈশ্বরদীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় এক্সকাভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনা আবাসিক হলের নামফলক এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শেখ রাসেল আবাসিক হলের নামফলক ভেঙে দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহ
ময়মনসিংহ নগরের সার্কিট হাউস মাঠসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে।
ঢাকার সাভার
ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলায় শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালের বেশ কিছু অংশ ভাঙচুর করার খবর মিলেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
ঝালকাঠি
ঝালকাঠিতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।
মাদারীপুর
মাদারীপুরে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করেছে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা।
নরসিংদী
নরসিংদী জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে।
নওগাঁ
নওগাঁয় এক্সকাভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। আজ বিকেল পাঁচটা থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ভাঙচুর শুরু করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
সাততলাবিশিষ্ট নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় শহরের সরিষাহাটির মোড় এলাকায় অবস্থিত।
পঞ্চগড়
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় এক্সকাভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের দুটি ম্যুরাল।
সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরা শহরে হাসপাতাল মোড়, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
পটুয়াখালী
পটুয়াখালী জেলা পরিষদ চত্বরে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে সার্কিট হাউসসংলগ্ন শেখ রাসেল শিশুপার্কের কাছে শেখ মুজিবের আরেকটি ম্যুরাল ভাঙা হয়।
টাঙ্গাইল
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় গুঁড়িয়ে দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য প্রয়াত সভাপতি ও টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র জামিলুর রহমানের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।