নির্বাসিত শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের রায়, আওয়ামী লীগের প্রত্যাখ্যান

সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে ভারতে নির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

অপর দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড, রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে গুরুদণ্ড থেকে পার পেয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। পেয়েছেন ৫ বছরের কারাদণ্ড।

সোমবার বিচারক গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ সোমবার এই রায় ঘোষণা করে। ৪৫৩ পৃষ্ঠার এই রায়ে ছয়টি অংশ ছিল।

এর মধ্য দিয়ে চব্বিশের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রথম রায় এল। অভিযোগ দায়ের থেকে রায় ঘোষণার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে নজিরবিহীন দ্রুততায়, যা বিচারের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে।

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের আইনজীবী সরকারের নিয়োগে হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়ার গোড়া থেকেই বিতর্ক শুরু হয়।

আওয়ামী লীগ এই বিচার প্রক্রিয়াকে ক্যাঙ্গারু কোর্টের বিচার হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে। দলটি বলছে, এই পরিস্থিতি বিচার প্রক্রিয়াকে একটি নিয়ন্ত্রিত প্রহসনে পরিণত করেছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

ইতোমধ্যে এ বিষয়ে জাতিসংঘে শেখ হাসিনার পক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেছেন দুই ব্রিটিশ আইনজীবী স্টিভেন পাওয়েলস কেসি ও তাতিয়ানা ইটওয়েল।

২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। অক্টোবরেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয় এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ৩৯৭ দিনে ‘মিসকেস’ থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে।

রায়ের ঘোষণায় ট্রাইব্যুনাল বলেছে, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটি অভিযোগ শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অন্য একটি অভিযোগ তাকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে গুরুদণ্ড থেকে পার পেয়েছেন মামুন, পেয়েছেন ৫ বছরের কারাদণ্ড।

এ মামলায় মামুনই একমাত্র আসামি যাকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বাকিদের পলাতক দেখিয়ে বিচারকার্য শেষ করা হয়।

মামুন দাবি করেছে, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার নির্দেশেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে ‘লেথাল উইপন’ বা প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র আন্দোলন দমন করা হয়েছিল।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ নির্দেশনার কারণে দেড় হাজার মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে, আহত হয় ৩০ হাজার মানুষ।

সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত

রায়ে দণ্ডের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নামে দেশে থাকা সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশন যুক্তিতর্কে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড দাবি এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আবেদন জানিয়েছিল।

আপিলের সুযোগ নেই

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে সাজা দিয়েছে সেটি আসামিরা যেদিন গ্রেপ্তার হবেন সেদিন থেকে কার্যকর হবে।

প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “মামলায় দুজন আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আর একজন রাজস্বাক্ষী হওয়ায় সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে”।

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান বর্তমানে ভারতে অবস্থান করায় তারা আপিল করতে পারবেন না। আইন অনুযায়ী পলাতক অবস্থায় আপিল শুনানি সম্ভব নয়।

প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার জানিয়েছেন, আত্মসমর্পণ বা গ্রেপ্তার হওয়া ছাড়া আসামিদের জন্য কোনো আইনি পথ খোলা নেই।

এ মামলায় ৮১ জন সাক্ষীর তালিকা থাকলেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে ৫৪ জনের। এদের বড় অংশ জুলাই আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী বা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি। এর মধ্যে আছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, জুলাই আন্দোলন নেতা নাহিদ ইসলাম, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ।

শেখ হাসিনার ব্রিটিশ আইজনীবীরা জাতিসংঘে দায়ের করা আবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরে বলেছেন, সব মিলিয়ে এই বিচার প্রক্রিয়া ন্যূনতম মানদণ্ড অনুসরণে ব্যর্থ হয়েছে।

মামলার গতি ও কাঠামোর কারণে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই এই রায়কে “রাজনৈতিক প্রতিশোধের বিচার” হিসেবে দেখছেন।

রায় প্রত্যাখ্যান আওয়ামী লীগের

মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় ভিডিও বার্তায় সভাপতিমণ্ডলির সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক এ কথা বলেছেন।

তিনি বলেন, “অবৈধ আদালত যে মামলার রায় দিয়েছে সেটি ১৪ আগস্ট শুরু করে ১৭ নভেম্বর মামলা শেষ করেছে। ৮৪ জন সাক্ষীকে সামনে রেখে ৫৪ জনকে হাজির করে ২০ দিনে মামলা শেষ করেছে। এই দুই মাসের মধ্যে মাত্র ২০ দিন আদালত চলেছে।”

“এর প্রধান বিচারক গত এক মাস অনুপস্থিত ছিলেন। তারপরেও প্রতিশোধের লক্ষ্য নিয়ে মানুষের প্রিয় নেত্রীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে,” বলছিলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক।

অচিরেই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads