মাস তিনেক আগেও চড়া সুরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, “আই হ্যাড এনাফ, লাস্ট সেভেন অর এইট মান্থ আই হ্যাড এনাফ।” কী প্রসঙ্গে বলেছিলেন সেকথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর অরাজকতায় অতিষ্ঠ মানুষের মনের কথা যে তিনি বলেছিলেন তা অস্বীকার করার জো নেই।
এরপর জল গড়িয়েছে অনেক; তাকেও যেমন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, হারিয়ে গিয়েছিল তার কথার ধার। অনেকটা গুটিয়ে রেখেছিলেন বলা চলে। যা থেকে কেউ কেউ ধারণা করে বসেছিলেন ‘নাটাই’য়ের কর্তৃত্ব ওয়াকারের হাতে নেই। অবশ্য তার সর্বশেষ বক্তব্যে ভিন্ন ইঙ্গিতই মিলছে।
বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে জেনারেল ওয়াকার যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে নির্বাচন নিয়ে তার অনড় অবস্থানের চিত্রই সামনে আসে।
তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ বিষয়ে তার অবস্থান আগের মতোই। অর্থ্যাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে তিনি অনড়।
এর আগেও বারকয়েক সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার দৃঢ় অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন।
ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেছিলেন, “আমি যতবারই ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি সর্ম্পূণভাবে আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন। দেয়ার শুড বি ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশন। এবং সেই ইলেকশন ডিসেম্বর অথবা এর কাছাকাছি সময়ে হবে।”
এবার অবশ্য তার চেয়েও এককাঠি বাড়িয়ে বার্তা আরও স্পষ্ট করেছেন ওয়াকার-উজ-জামান।
তিনি বলেছেন, “আমি আশা করছি ১ জানুয়ারি ২০২৬ থেকে নতুন নির্বাচিত সরকার বাংলাদেশ পরিচালনা করবে।”
ওয়াকারের বক্তব্য থেকে এতটুকু স্পষ্ট মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে ‘লুকোচুরি’ করলেও তাতে ‘সায় নেই’ সেনাপ্রধানের।
ঢাকায় অবস্থানরত সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা বুধবারের ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ভার্চ্যুয়ালিও যুক্ত হন অনেকে।
ভাষণে নির্বাচন ছাড়াও করিডর, বন্দর, সংস্কারসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সেনাপ্রধান কথা বলেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মব সংস্কৃতি নিয়ে অসন্তোষ ঝরেছে জেনারেল ওয়াকারের কণ্ঠে।
তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী আর সহিংসতা বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ সহ্য করবে না, কঠোরভাবে নিয়ম প্রতিপালনের দিকে সচেষ্ট থাকবে।
রাস্তায় মব তৈরি করে অরাজকতা আর মানা হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
২০০৭ সালে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে জরুরি অবস্থা জারির পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। কিন্তু সেই সরকারের নাটাই যে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের হাতে ছিল, তা নিয়ে কোনো রাখঢাক ছিল না। সেই কারণে সেই সরকারকে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা হয়।
কিন্তু এবারের সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকলেও হস্তক্ষেপ তেমন টের পাওয়া যাচ্ছিল না। বরং বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী মাঠে থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিই দেখতে হচ্ছে দেশবাসীকে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিন দিন সরকারশূন্য হয়েছিল দেশ। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়, দলটি সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ও নেতাদের বাড়ি-ঘর নির্বিচারে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল সারাদেশে। হামলা হয়েছে মাজার, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরও।
এর পরের দিনগুলোর পরিণতি ছিল আরও ভয়ানক। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ধানমণ্ডির বত্রিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের।
জুলাই অভ্যুত্থানে প্রবাসে থেকে সমর্থন দেওয়া ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য অবশ্য সেনাপ্রধানের সুরে ভারতের স্বার্থই খুঁজে পেয়েছেন, যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে অনুসারীদের উস্কে দেওয়ার অভিযোগ পুরনো।
প্যারিসে থেকে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলার আহ্বান তিনিই জানিয়েছিলেন।
ফেইসবুকে পিনাকী লিখেছেন: “দেশবাসী সাবধান: জেনারেল ওয়াকাররা ইন্ডিয়ার স্বার্থে দেশের রাজনৈতিক গতিমুখ অন্যদিকে ঘুড়িয়ে দিচ্ছে।”
তার অভিযোগ, “বাংলাদেশের সেনাপ্রধান একজন ইন্ডিয়া অনুরাগী ব্যক্তি। তিনি আওয়ামী লীগকে অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদে নির্বাচন সম্পন্ন করার পক্ষ প্রায় প্রকাশ্যেই বলেছেন। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নিয়মিত ইন্ডিয়ার সেনাপ্রধানের সাথে কথা বলে তার পরামর্শে কাজ করেন। এটা ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে বারংবার দাবি করা হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ার পালকি শর্মা ওয়াকারকে ভারতপন্থী জেনারেল বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষ অবলম্বন করে তিনি এই অপরাজনীতি করেই যাচ্ছেন।”
জেনারেল ওয়াকারের বক্তব্য খণ্ডন করে পিনাকী আরও লিখেছেন, “সেনাপ্রধানের দেয়া বক্তব্য বলে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করলে তিনটি সত্য উদঘাটিত হয়।
“প্রথমত; ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় জেনারেল ওয়াকারসহ তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ছোট্ট গ্রুপটি খুবই বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে। কোন কারণ না থাকার পরও এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটি বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে বা চাকুরী হারানোর ঝুঁকিতে ক্লান্ত, হতাশ ও কাতর হয়ে পড়েছে!
“দ্বিতীয়ত; সেই কারণে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রম, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ এবং জুলাই ঘোষণা বা প্রক্লামেশনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্যোগে নিয়েছে।
“তৃতীয়ত; সরাসরি জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এই গোষ্ঠিটি শত্রু ভাবাপন্ন ইন্ডিয়ার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।”
জেনারেল ওয়াকার অবশ্য দেশের প্রতি সেনা সদস্যদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ দরিদ্র, তাদের ঘাম-রক্তের অর্থে আমাদের সবার বেতন হয়, সংসার চলে। তাদের স্বার্থবিরোধী কোন কাজই যেন না ঘটে সে বিষয়ে আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।”
সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাওয়া উচিত, তবে নির্বাচনের পরেও সেনাবাহিনীকে কয়েক মাস বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে হতে পারে।
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
সেনাপ্রধানের কড়া বার্তার পর খলিল বললেন, করিডোর হচ্ছে না
নাটাই কি জেনারেল ওয়াকারের হাতছাড়া?