গ্রহাণু কী, কোথা থেকে আসে

পৃথিবীর আশেপাশে বিচরণ করা গ্রহাণু ‘নিয়ার-আর্থ অ্যাস্টেরয়েড’ নামে পরিচিত।
পৃথিবীর আশেপাশে বিচরণ করা গ্রহাণু ‘নিয়ার-আর্থ অ্যাস্টেরয়েড’ নামে পরিচিত।

মহাকাশে প্রতিনিয়তই ছুটে বেড়ায় ছোট-বড় নানা আকারের পাথরের চাঁই, যা অ্যাস্টেরয়েড বা গ্রহাণু নামে পরিচিত। এসব গ্রহাণু অনেক সময় আছড়ে পড়ে সৌরজগতে থাকা কোনো কোনো গ্রহের ওপর। পৃথিবীর আশেপাশেও আছে এমন সব গ্রহাণুর বিচরণ, যাদের বলা হয় ‘নিয়ার-আর্থ অ্যাস্টেরয়েড’ (এনইএ)।

সম্প্রতি এমনই একটি ‘নিয়ার-আর্থ অ্যাস্টেরয়েড আবিষ্কৃত হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন অ্যাস্টেরয়েড ২০২৪ ওয়াইআর৪। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আবিস্কৃত এই গ্রহাণুটির পৃথিবী বা চাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটতে পারে কি না তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তৈরি কৌতূহল তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্যের বরাত দিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর একটি গাড়ির সমান আকারের অন্তত একটি গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। তবে এক্ষেত্রে ঢাল হয়ে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে দেয় তার বায়ুমণ্ডল। কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাতে আগুন জ্বলে ওঠে এবং গ্রহাণুটি অনেকটা উল্কাপিণ্ড বা আগুণের গোলার মত আকাশে ভাসতে থাকে।

তবে আরও বড় আকৃতির গ্রহাণুগুলোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হতে পারে ভিন্ন। যেমন ১০ কিলোমিটার চওড়া একটি গ্রহাণুই পৃথিবীতে ডাইনোসরদের বিলুপ্তির কারণ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, এত বড় আকারের গ্রহাণু গড়ে প্রতি ১০ কোটি বছরে একবার পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা থাকে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আবিষ্কৃত ওয়াইআর৪ নামের গ্রহাণুটি প্রায় ৫৩ থেকে ৬৭ মিটার চওড়া, অর্থাৎ একটি ১০ তলা ভবনের সমান। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, ২০৩২ সালের ২২ ডিসেম্বর এটি পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনা ১.২ শতাংশ। পরে সেটি বেড়ে ৩.১ শতাংশ হলেও বর্তমানে আবার সেই ঝুঁকি নেমে এসেছে মাত্র ০.০০১ শতাংশে।

তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সঙ্গ সংঘর্ষের আশঙ্কা না থাকলেও পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে। যদিও এটা চাঁদের কক্ষপথে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে তারা আশ্বস্ত করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে—এই গ্রহাণুগুলো আসে কোথা থেকে? জবাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, এরা মূলত সৌরজগতের মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝখানের একটি গ্রহাণু বেল্ট বা বলয়ে অবস্থান করে। সেই বেল্ট থেকে বৃহস্পতির মহাকর্ষ বল বা অন্য কোনো সংঘর্ষের কারণে কিছু গ্রহাণু তাদের স্বাভাবিক কক্ষপথ ছেড়ে ভিন্ন পথে চলে আসে, তখনই তারা পৃথিবীর মতো গ্রহের কাছে চলে আসে।

নাসার গবেষকরা বলছেন, প্রতিটি গ্রহাণুই মূলত প্রাচীন কোনো বৃহৎ বস্তুর খণ্ডিত অংশ, যা সৌরজগতের জন্মলগ্ন তৈরি হয়েছিল। তাই এগুলোর গঠন ও উপাদান বিশ্লেষণ করে আমরা সেই প্রাচীন সময়ের পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারি।

এই ধরনের গবেষণার উদ্দেশ্য শুধু বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতাও বটে। যেমন, ২০২২ সালে নাসার ডার্ট মিশন একটি গ্রহাণুর গতিপথ বদলে দিয়ে দেখিয়েছে যে, ভবিষ্যতে যদি কোনো গ্রহাণু পৃথিবীমুখী হয়, তবে তাকে প্রতিরোধ করাও সম্ভব।

কুইন্স ইউনিভার্সিটি বেলফাস্টের জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যালান ফিটজসিমন্স বলেন, “বেশিরভাগ গ্রহাণু সৌরজগতের জন্মের সময় গঠিত বৃহৎ বস্তুর টুকরো। এদের রাসায়নিক গঠন অধ্যয়ন করে আমরা ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের সৌরজগতের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাই।” এই প্রাচীন শিলার ধ্বংসাবশেষকে কখনো কখনো ক্ষুদ্র গ্রহ বলা হয়। এগুলো সাধারণত অনিয়মিত আকৃতির এবং গর্তযুক্ত, তবে গোলাকারও হতে পারে।

ফিটজসিমন্স বলেন, “ওয়াইআর৪ গ্রহাণু বেল্ট থেকে এসেছে। এটির পৃষ্ঠের বর্ণালী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এটি শিলাময় এবং কার্বনের মতো হালকা উপাদানে কম, যা ইঙ্গিত করে এটি গ্রহাণু বেল্টের অভ্যন্তরীণ অংশ থেকে এসেছে।” তবে এর সঠিক উৎস জানা সম্ভব নাও হতে পারে। সব গ্রহাণুর গঠনও এক নয়— কিছু পাথুরে, কিছু কার্বনযুক্ত, আবার কিছু ধাতব।

নাসার প্ল্যানেটারি ডিফেন্স অফিসার কেলি ফাস্ট বলেন, “টেলিস্কোপে গ্রহাণু একটি আলোর বিন্দু হিসেবে দেখায়, যা তারার মাঝে চলমান।” এদের উজ্জ্বলতা আকার ও রঙের ওপর নির্ভর করে। ওয়াইআর৪-এর আকার আরও নির্ভুলভাবে জানতে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে তাপ নির্গমন পরিমাপ করা হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads