খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া।

গত সাড়ে চার দশক ধরে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে দুজনকে ঘিরে, তারা হলেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা। তাদের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিকে দুই বেগমের লড়াইয়ের ময়দান হিসাবেই দেখা হতো পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে। সেই খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার একজনই দেশে দেশে নেই চার মাস হলো।

অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে ওঠা শেখ হাসিনা ‘টুস করে দেশে ঢুকে পড়ব’ বললেও তার আশু ফেরার কোনো ইঙ্গিত মিলছে না। শেখ হাসিনার পতনে কারামুক্ত হয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত জানুয়ারিতে চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলে দেশ আক্ষরিক অর্থেই দুই নেত্রী শূন্য হয়ে পড়ে।

একে রসিকতা করে ‘মাইনাস টু’র প্রয়োগ বলে মন্তব্য করছিলেন অনেকেই। ভুলে যাওয়ার কথা নয়, এখন যেমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রয়েছে, ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থা জারির পর তেমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে ‘আউট’ করে দেওয়ার একটি চেষ্টা চালিয়েছিল।

সেই চেষ্টায় দুই নেত্রীর বিকল্প হিসেবে যাকে নিয়ে ছক সাজানো হয়েছিল, সেই নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এখনকার অন্তর্রর্তীকালীন সরকারের প্রধান।

ফলে আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুক্তি পেয়েও খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে চাইছিলেন না; যদিও তার আগে বিএনপি বলে আসছিল, বিদেশে নেওয়ার অনুমতি না দিয়ে তাদের নেত্রীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি নেতারা তখন আভাসে-ইঙ্গিতে বলেছিলেন যে তারা আবার ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়নের আলামত পাচ্ছেন।

শেষে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেখা করে আসার পর গত জানুয়ারিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সৌজন্য সাক্ষাতের আড়ালে তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। 

ছেলে তারেক রহমানকে রেখে এলেও পুত্রবধূ জোবাইদা রহমানকে নিয়ে দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া।

লন্ডনে ছেলে তারেক রহমানের কাছে যান খালেদা জিয়া, সেখানে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পর ছেলের বাসায় ওঠেন তিনি।

কিন্তু তারপর মাস গড়ালেও তার দেশে ফেরার কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় আবার নানা সন্দেহ ডাল-পালা গজায়। তবে সেই সব গুঞ্জন উড়িয়ে সোমবার রাতে হিথরো বিমানবন্দর থেকে উড়লেন খালেদা জিয়া, মঙ্গলবার সকালে নামবেন ঢাকায়।

দুই বার প্রধানমন্ত্রী, দুই বার বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালনকারী খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৮০ ছুঁইছুঁই, নানা অসুস্থতায় শরীরও কাবু, চলাচল করেন হুইল চেয়ারে, দল পরিচালনার ভারও ছেড়ে দিয়েছেন ছেলের হাতে; এই অবস্থায় তার ফেরার গুরুত্ব কোথায়?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গুরুত্ব আছে। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব এখন আরও বেশি।

সাংবাতিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার নবনীতা চৌধুরী বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন এভাবে- “বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাদে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা যায়, এমন কেউ নেই। শেখ হাসিনা তার ১৭ বছরের শাসনে রাজনীতিতে নিজেকে বিকল্পহীন একটি জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন, ড. ইউনূস এখন বাংলাদেশে সেই সুবিধাটুকু পাচ্ছেন।”

ফলে রাজনীতির মাঠে থেকে ইউনূসকে চ্যালেঞ্জ জানানোর যে শক্তি, তা এখন খালেদা জিয়ার ছাড়া অন্য কারও নেই। কারণ এখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি েশখ হাসিনা অনুপস্থিত।

গত শতকের ৮০ এর দশকে এই দু্ই নেত্রী সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। তাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে ছেড়েছিলেন তারা। এক আন্দোলনে থাকা দুজনের বিরোধ শুরু হয় তারপর থেকে।

তবে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর বন্দিত্ব আবার দুজনে এক করে দেয়। তাদের আন্দোলনের চাপে নির্বাচন আসে। তাতে ক্ষমতায় যান শেখ হাসিনা। এবার তিনি খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে সরাতে তৎপর হন। দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে বন্দি হন খালেদা, হারান নির্বাচন করার যোগ্যতা।

এখন যে ইউনূস সরকার রয়েছে, নির্বাচন নিয়ে তাদেরও গড়িমসি দেখছেন রাজনৈতিক নেতারা। দ্রুত নির্বাচন দিতে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে চাইছে বিএনপি। দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে সেই চাপ বাড়াতে খালেদাকে প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

নবনীতা চৌধুরীর ভাষায়- “খালেদা জিয়া দেশে না ফিরলে বাংলাদেশের মানুষের নির্বাচনের যে দাবি, সেটা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা মির্জা আব্বাস কিংবা রুহুল কবির রিজভী তুঙ্গে তুলতে পারবেন, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

“মানুষ বারবারই ভাববে, নির্বাচন এলে কে হবেন বিএনপির নেতা, কে নেবেন দেশের শাসনভার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তির বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে সেনাপ্রধান ওয়াকারকে হয়ত কেউ কল্পনা করবেন, কিন্তু জনগণ এখনও প্রস্তত নন রাজনৈতিক দলবিহীন কারও পেছনে দাঁড়াতে।”

বিএনপির জন্যও খালেদা জিয়ার ফেরাটা গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখা হচ্ছে। কারণ আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি, দুই দলের কর্মীদের কাছে এখনও নেতা মানেই শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার উপস্থিতিই বিএনপির শক্তি অনেক বাড়িয়ে দেয়, তাই তার দেশে ফেরা ঘিরে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের কমতি নেই।

সাংবাদিক হাসান মামুন সমকালে প্রকাশিত এক কলামে লিখেছেন, “জানুয়ারির শুরুতে লন্ডন যাত্রার সময় দলের নেতাকর্মী, সমর্থকরা বিমানবন্দর পর্যন্ত তাকে (খালেদা জিয়া) যে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, সেটা সবার মনে আছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কখনোই পরাস্ত হননি তিনি। গণতন্ত্রে উত্তরণে রাখা ভূমিকার জন্য তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ বলা হয়। সংযত রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্যও তিনি প্রশংসা পেয়েছেন।”

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে তারেক রহমান বিএনপি পরিচালনা করে গেলেও দলটির নেতা-কর্মীদের কাছে এখনও খালেদা জিয়াই তাদের ‘রাজনৈতিক সম্পদ’।

সম্প্রতি এক সময়ের জোটসঙ্গী দল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুরু হয়েছিল, তাদের সম্পর্ক নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এরপর জামায়াত আমির শফিকুর রহমান লন্ডন গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসার পর তা প্রশমিত হতে দেখা যায়।

এমন সব পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া সক্রিয়ভাবে মাঠের নেতৃত্বে আগের মতো না থাকলেও তার নির্দেশনাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখাচ্ছেন সাংবাদিক হাসান মামুন।

সেই সঙ্গে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বিএনপির কাছে। তা হলো তারেক রহমানের দেশে না ফেরা। ১৮ বছর আগে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়েই সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। তারপর আওয়ামী লীগ আমলে চারটি মামলায় দণ্ডের রায়ের পর দেশমুখো হওয়ার কথা চিন্তা করেননি তিনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মামলাগুলো থেকে খালাস পেলেও তারেক এখনও ফেরার সিদ্ধান্ত নেননি। বিএনপি নেতারা বলছেন, তারেকের ফেরার পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি।

রাজনৈতিক অঙ্গনে ধারণা, তারেক এখনও পুরোপুরি আশঙ্কা মুুক্ত হতে পারছেন না যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি দেশে ফিরে নিরাপদে থাকতে পারবেন। ফলে নির্বাচনের ফল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন তিনি।

সাংবাদিক হাসান মামুন লিখেছেন, “গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে কিছু ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ সব সময় উড়ে বেড়াচ্ছে। তারেক রহমান ঘিরেও এটা রয়েছে। মামলাগুলোর নিষ্পত্তি তার পক্ষে গেলেও মহলবিশেষ নাকি তাকে দেশে ফিরতে দিতে নারাজ। দলের ক’জন সিনিয়র নেতার মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের কথাও শোনা যায়।”

আর সেক্ষেত্রে নির্বাচন পর্যন্ত খালেদা জিয়াকেই দল চালিয়ে নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সঙ্গী হিসেবে তিনি লন্ডন থেকে নিয়ে আসেছেন তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে, যিনি রাজনীতিতে বরাবরই ছিলেন অনাগ্রহী।

কিন্তু ১৮ বছর পর এই সময়ে শাশুড়ির সঙ্গে জোবাইদার ফেরাও বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জল্পনা চলছে যে জোবাইদা কি বিএনপিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে যাচ্ছেন? তবে তাহলেও যে সেটা শুধু নির্বাচন পর্যন্তই হবে, তা অনেকটাই স্পষ্ট।

সাংবাদিক হাসান মামুন লিখেছেন, “২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে রটেছিল, খালেদা জিয়া কারান্তরীণ এবং তারেক রহমান বিদেশে অবস্থানে বাধ্য হওয়ায় জোবাইদা দলের নেতৃত্ব দিতে আসবেন! মামলা থাকায় কিংবা যে কারণেই হোক, সেটি ঘটেনি। তারেক রহমানকেই বরং আরও নিবিড়ভাবে বিএনপির নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। তারেক রহমান যথাসময়ে দেশে ফিরে দল পরিচালনা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক।”

বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পর খালেদা জিয়া বলেছিলেন, “দেশের এই মুহূর্তে আমাকে দেশে যাওয়াটাও প্রয়োজন।”

শারীরিক সামর্থ্য কমে গেলেও এবার তার দেশে ফেরাটা আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, বুঝেছেন তিনিও।

আরও পড়ুন