বাণিজ্য যুদ্ধে চীন জিতলে কী হবে

trade war

ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জিততে চাইলেও তার নীতিগত অবস্থান ও কৌশল এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, শেষ পর্যন্ত চীনকেই ভূ-রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। এতে বেইজিং শুধু সামরিকভাবে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মর্যাদা ও অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এই মাসের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের সব পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ করেছে। এর জবাবে চীনও আমেরিকান পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে এবং এর সঙ্গে আরও কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি একটি ক্লাসিক বাণিজ্যযুদ্ধ—যেখানে দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপ করে চলেছে। আর এর উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষকে পিছু হটতে এবং নির্দিষ্ট কিছু দাবি মানতে বাধ্য করা।

ট্রাম্প প্রশাসনের ধারণা, এই লড়াইয়ে তাদের সুবিধা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট সম্প্রতি বলেন, “আমরা তাদের তুলনায় এক-পঞ্চমাংশ রপ্তানি করি, তাই এটি তাদের জন্য একটি ক্ষতিকর হিসাব।” কিন্তু এই ধারণা বাস্তবতা থেকে দূরে। 

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনা পণ্যের ওপর যে মাত্রায় নির্ভরশীল, সেটিই আসলে তাদের দুর্বলতা। অনেক ক্ষেত্রেই চীন শুধু আমেরিকার প্রধান সরবরাহকারীই নয়, বরং গোটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। ফলে এসব পণ্য সহজেই অন্য কোনো দেশ থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জেসন মিলারের তথ্য মতে, চীন বিশ্বজুড়ে ৭০ শতাংশের বেশি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, এয়ার কন্ডিশনার ও কুকওয়্যার উৎপাদন করে। এছাড়া তারা ৮০ শতাংশের বেশি স্মার্টফোন, রান্নাঘরের যন্ত্রপাতি ও খেলনা এবং প্রায় ৯০ শতাংশ সৌরপ্যানেল ও প্রক্রিয়াজাত বিরল খনিজ সরবরাহ করে। এই বিরল খনিজ উপাদানগুলো গাড়ি, ফোন এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য।

এই ধরনের পণ্য ঘরোয়া উৎপাদনে রূপান্তর করতে বহু বছর, এমনকি দশকও লেগে যেতে পারে। এর জন্য নতুন কোম্পানি গঠন, কারখানা নির্মাণ, সরবরাহ চেইন গড়ে তোলা ও কর্মী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এ কাজ সফলভাবে করতে হলে, কোম্পানিগুলোর মধ্যে এই আস্থা থাকতে হবে যে, শুল্ক নীতিগুলো দীর্ঘমেয়াদে বহাল থাকবে। 

অন্যদিকে চীন খুব অল্প কিছু পণ্যের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সয়া ও সরগাম। এই পণ্যগুলো তারা সহজেই অন্য দেশ থেকেও আমদানি করতে পারে।

চীনা ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার হারিয়ে কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়বে। তবে এই সমস্যা তুলনামূলকভাবে সহজে সমাধানযোগ্য। চীন তার কিছু রপ্তানি ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। কারণ সেসব দেশের নাগরিকদেরও মোবাইল ফোন, খেলনা ও টোস্টারের মতো পণ্যের প্রয়োজন হয়। 

পাশাপাশি বেইজিং তার নিজস্ব নাগরিকদের হাতে অর্থ তুলে দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে পারে এবং দেশীয় ব্যবসাগুলোকে ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করতে পারে।

এই অসমতা চীনকে একটি কৌশলগত সুবিধা দেয়, যাকে অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম পোজেন “এস্কেলেশন ডমিনেন্স” নামে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর অসমভাবে বেশি ক্ষতি চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা।

এস্কেলেশন ডমিনেন্স হলো একটি কৌশলগত সামরিক ও রাজনৈতিক ধারণা, যেখানে এক পক্ষ যেকোনো সংঘাতের স্তর বাড়ানোর ক্ষেত্রে অপর পক্ষের উপর আধিপত্য বজায় রাখে।

চীনের এই সুবিধা বহু বছরের সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতির ফল। অনেক চীন পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে ট্রাম্পের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধ—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর গড়ে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল—বেইজিংকে সতর্ক করেছিল। 

আর তখন থেকেই তারা বুঝেছিল যে, যেকোনো সময় অর্থনৈতিক সংঘাতে জড়ানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই সময় থেকে চীন জ্বালানি, কৃষি ও সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের মতো খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে।

একইসঙ্গে চীন অভ্যন্তরীণ ভোক্তা চাহিদা বৃদ্ধির কৌশল নিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা এড়িয়ে নতুন রপ্তানি বাজার খুঁজতে শুরু করেছে। এই সব প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভাষায়, “চরম পরিস্থিতির মধ্যেও জাতীয় অর্থনীতির স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখা।”

বেইজিং কেবল প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপেই থেমে নেই। বরং তারা আক্রমণাত্মক অর্থনৈতিক অস্ত্রের ভাণ্ডারও গড়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে চীন বিরল খনিজের কয়েকটি প্রজাতির রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে, যাতে গাড়ি ও ফোনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তা পণ্য এবং সাবমেরিন ও যুদ্ধবিমানসহ সামরিক সরঞ্জামের সঙ্কট দেখা দেয়। 

তারা ডু পন্ট এবং গুগলের বিরুদ্ধে অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্ত শুরু করেছে এবং বোয়িং—যা আমেরিকার শীর্ষ বিমান নির্মাতা—এর সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে বেইজিং অ্যাপল ও টেসলার মতো যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নামকরা কোম্পানিকে চীনে ব্যবসা করার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। 

আর রয়েছে সবচেয়ে কড়া পদক্ষেপ।  চীন হলো যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক ঋণধারক, তারা দ্রুত তাদের হাতে থাকা ৭৬০ বিলিয়ন ডলারের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড থেকে বিক্রি করে দিতে পারে। এই পদক্ষেপ সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করবে এবং সম্ভবত একটি আর্থিক সঙ্কটের সূচনা ঘটাতে পারে।

আর “চীন এই লড়াইয়ের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত,” বলেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জননীতি অধ্যাপক এবং চীনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ইয়েলিং টান। তার মতে, “চীন অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।”

এই সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন—যুক্তরাষ্ট্র সঠিকভাবে সব কিছু করলে এখনও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে।

চীনের কিছু স্বাভাবিক সুবিধা থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোপন শক্তি আছে—তার মিত্ররা। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে এবং নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর করলে এই জোট চীনের ওপর অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। চীনের বিকল্প বাজার কম থাকায় তাদের ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। আর মিত্র জোট নিজেরা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কারণ চীনা পণ্যের বিকল্প তারা সহজেই ও দ্রুত পেতে পারে।

এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের একটি বিশাল সমন্বিত অর্থনৈতিক উদ্যোগে নামতে হবে। তাদের নতুন শিল্প গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা নজরদারির জন্য প্রশিক্ষিত আমলাদের দিয়ে একটি নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে কেউ প্রতারণা না করতে পারে। তাদের ধাপে ধাপে বাণিজ্য সীমাবদ্ধতা কার্যকর করতে হবে, যাতে ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীরা মানিয়ে নেওয়ার সময় পায়। আর স্পষ্টভাবে জানাতে হবে, কী শর্তে তারা বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ করতে রাজি হবে। এটি একটি আংশিক তালিকা মাত্র।

কিন্তু ট্রাম্প এই সব কিছুর ঠিক উল্টো কাজ করেছেন। তিনি বহু বছর তো দূরের কথা, কয়েক মাসও সময় দেননি আমেরিকান শিল্পে বিনিয়োগের জন্য। বরং তিনি বাইডেন প্রশাসনের অধীনে শুরু হওয়া সেমিকন্ডাক্টর ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানিখাতে যে বড় বিনিয়োগ হয়েছিল, তা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

তিনি ধাপে ধাপে শুল্ক আরোপ করেননি। বরং মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের কোনো পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দেননি। প্রায় প্রতিদিন, কখনো কখনো প্রতি ঘণ্টায়, নিজের বক্তব্য পাল্টে ফেলেছেন। 

মিত্রদের সঙ্গে একটি জোট গড়ে তোলার বদলে ট্রাম্প গত কয়েক মাস ধরে তাদের হুমকি দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে বিরোধে জড়াচ্ছেন এবং তাদের ওপরও শুল্ক আরোপ করছেন।

এখন হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র দিক পরিবর্তন করে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠনের চেষ্টা করলেও—যেমনটি সম্প্রতি স্কট বেসেন্ট প্রস্তাব করেছেন—তা হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। এমন কোনও দেশ কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একত্র হবে, যেটি শুধু তাদের খারাপ ব্যবহার করেছে তা-ই নয়, বারবার প্রমাণ করেছে যে, কোনো চুক্তি মেনে চলার মতো বিশ্বাসযোগ্যতা তার নেই?

একটি বাণিজ্যযুদ্ধের ফল শুধু আরোপিত ক্ষতির উপর নির্ভর করে না। এটি নির্ভর করে প্রতিটি দেশের সেই ক্ষতি সহ্য করার মানসিক শক্তির ওপরও। এই দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইতিবাচক দিক আছে—দেশটির ভোটাররা সাধারণভাবে চীনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানকে সমর্থন করে।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব অঞ্চলে আমদানি শুল্কের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল, সেসব স্থানের ভোটাররা ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন করার প্রবণতা বেশি দেখিয়েছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সিবিএস নিউজের করা এক জরিপে দেখা যায়, ৫৬ শতাংশ ভোটার চীনের ওপর নতুন শুল্ক আরোপকে সমর্থন করেছেন। যদিও মেক্সিকো, কানাডা ও ইউরোপের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়ে তারা বিরোধিতা করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, ভোটাররা চীনকে শাস্তি দেওয়ার যে ইচ্ছা পোষণ করেন, তা কি পণ্যের দীর্ঘমেয়াদি ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধির যন্ত্রণা থেকেও বেশি প্রভাব ফেলবে? ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীনের বিরুদ্ধে যে শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, তা তুলনামূলকভাবে সীমিত ছিল। ফলে তখন বড় ধরনের মূল্যবৃদ্ধি হয়নি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এ পর্যায়ের শুল্কের কারণে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা উপেক্ষা করার উপায় থাকবে না।

২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোটাররা একযোগে মূল্যস্ফীতিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো—যে রাজনীতিক কম দামে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনিই ক্ষমতায় বসে বিপরীত পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন, তখন জনগণ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে?

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের নতুন শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই অধিকাংশ ভোটার তার এ পদক্ষেপের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন। পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলছে চীনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ। এটি যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের উপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং একইসঙ্গে শুল্কজনিত অনিশ্চয়তা ব্যবসায়ীদের হতাশ করবে। এর ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে।

অনেক অর্থনীতিবিদ সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আবার ১৯৭০-এর দশকের মতো ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর মুখোমুখি হতে পারে—যেখানে একদিকে মূল্যবৃদ্ধি হবে লাগামছাড়া, আর অন্যদিকে বেকারত্বও বাড়তে থাকবে। এই দুইয়ের মিলন একটি বিষাক্ত পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক—উভয় দিক থেকেই বিপজ্জনক।

এমনকি ট্রাম্প নিজেও হয়তো এত গভীর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো একগুঁয়েমি দেখাতে পারবেন না। তিনি ইতোমধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মটি ভেঙে ফেলেছেন—“কখনোই প্রতিপক্ষকে নিজের দুর্বলতার সীমা দেখিও না।” 

সম্প্রতি বন্ড বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তিনি তার বৈশ্বিক প্রতিশোধমূলক শুল্ক নীতিতে “বিরতি” দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি তার চাপ সহ্য করার সীমা প্রকাশ করে ফেলেছেন।

ট্রাম্প এবার আগের চেয়ে রাজনৈতিক চাপ কিছুটা বেশি সময় সহ্য করতে সক্ষম হলেও তিনি শি জিনপিংয়ের চেয়ে বেশিদিন টিকতে পারবেন না। কারণ শি জিনপিংয়ের কোনো মেয়াদসীমা নেই। তাকে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে হয় না। 

হুভার ইনস্টিটিউশনের গবেষক ড্যান ওয়াং বলেন, “বেইজিং অপেক্ষা করতে খুব ভালো পারে। তারা চিরকাল হয়তো অপেক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু অবশ্যই একটি নির্বাচনী মেয়াদের চেয়ে বেশি সময় ধরে লড়াই চালাতে পারবে।”

অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শেষপর্যন্ত ট্রাম্পকে পিছু হটতেই হবে। এর রূপ হতে পারে এমন একটি চুক্তি, যেখানে চীন কিছু প্রাথমিক ও প্রতীকী ছাড় দেবে, যা ট্রাম্পকে মুখ রক্ষার সুযোগ দেবে। (আগের ট্রাম্প-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ ঠিক এইভাবেই শান্ত হয়েছিল।) 

তবে এবার চীন হয়তো এত সহজে ট্রাম্পকে পিছু হটার রাস্তা দেখাবে না। সেক্ষেত্রে পিছু হটার রূপ হতে পারে বিভিন্ন খাতভিত্তিক শুল্ক ছাড় বা “কারভ-আউট”। এটা এতটাই ব্যাপক হতে পারে যে, মূল শুল্ক কার্যত গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। যেভাবেই হোক, ফলাফল একটিই হবে—যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নিজের ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে, অথচ বিনিময়ে তেমন কিছু অর্জন করতে পারবে না।

চীন বরং এই পরিস্থিতি থেকে অনেক কিছু অর্জন করবে। গত সপ্তাহে স্পেন সরকার ঘোষণা করেছে যে, তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে চায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানির ওপর চলমান বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে আলোচনায় ফিরে আসতে রাজি হয়েছে এবং জুলাই মাসে বেইজিংয়ে প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলনের জন্য একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে। 

দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পুনরায় আলোচনা শুরু করবে। শুধু এই সপ্তাহেই ভিয়েতনাম চীনের সঙ্গে ডজনখানেক নতুন অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আর প্রেসিডেন্ট শি এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সফরে আছেন। এর লক্ষ্য হলো আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করা।

বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের বিজয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়িয়ে আরও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক দিন ধরেই চীনবিরোধী কূটনীতিকরা দাবি করে আসছেন, চীনের আগ্রাসন—যেমন, তাইওয়ানে হামলা—থামানোর অন্যতম কার্যকর উপায় হলো অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি। 

কিন্তু বেইজিং প্রমাণ করে দিতে পারে, তারা এমন চাপ সহ্য করতে সক্ষম। তবে এই হুমকির কার্যকারিতা অনেকটাই হারাবে। এতে চীনের আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আর আমেরিকান রাজনীতিকদের পক্ষে অর্থনৈতিক চাপে চীনকে রোধ করার কৌশল আর জনপ্রিয় থাকবে না।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, একটি ব্যর্থ বাণিজ্যযুদ্ধ ভবিষ্যতে প্রকৃত যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। এমনও বলা যায়, ট্রাম্পের শুল্কনীতি অনেকটাই সেই “বিপর্যয়কর” যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানগুলোর মতো, যেগুলোর তিনি অতীতে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। শুধু পার্থক্য এটাই—এইবার সেই অভিযান তিনি নিজেই পরিচালনা করছেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads