খালেদা জিয়ার সঙ্গে কি তারেকও দেশে ফিরছেন?

গত ৮ জানুয়ারি লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মিলনের আবেগঘন মুহূর্ত।
গত ৮ জানুয়ারি লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মিলনের আবেগঘন মুহূর্ত।

‘উপযুক্ত সময়ে’ দেশে ফিরবেন তারেক রহমান- নেতাদের কাছ থেকে একথা বহু দিন ধরে শুনে আসছেন বিএনপির সমর্থকরা। গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই সময় এসেছে বলে তারা মনে করলেও দলের ভবিষ্যৎ কর্ণধার তারেক রহমানের আসাটা হয়নি।

এর মধ্যে মুক্ত খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য গেছেন ‍যুক্তরাজ্যে, কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর মাকে লন্ডনের নিজের বাসায় নিয়ে গেছেন তারেক। মা-ছেলে দুজনে এখন একসঙ্গে আছেন, দলও চালাচ্ছেন ভার্চুয়ালি।

দেশে ফিরতে উদগ্রিব বিএনপি চেয়ারপারসন রোজার ঈদের পরই ফিরতে পারেন, এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক কি মায়ের সঙ্গে ফিরবেন, সেই প্রশ্ন এখন ঘুরছে বিএনপি কর্মীদের মনে।

গত জানুয়ারিতে খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার পর দেশে সময় কিছুটা হলেও বদলেছে। মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নানা বিষয়ে বিএনপির দূরত্ব বেড়েছে। যাদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটেছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তো মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে।

এই অবস্থায় বিএনপিকে আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে যেতে দেশে তারেক রহমানের উপস্থিতি প্রত্যাশা করছেন বিএনপির তৃণমূলের নেতা ও কর্মীরা। তাদের নেতা ফিরবেন কবে, তা স্পষ্ট হতে চাইছেন তারা।

আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনে বড় চাপে ছিল বিএনপি। নির্বাচন করে কিংবা বর্জন করে কোনোভাবেই শেখ হাসিনার সঙ্গে পেরে উঠছিল না দলটি।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তারেক রহমান। পরের বছর মুক্তি পেয়ে বিদেশে চলে যান তিনি।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০০৮ সালে তারেক সপরিবারে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোর পর আর ফেরার কথা ভাবেননি। কারণ এরমধ্যে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় সাজার রায় হয়। আওয়ামী লীগ আমলে পাসপোর্টও নবায়ন করতে পারেননি।

তারেকের অনুপস্থিতির মধ্যে বিএনপির জন্য বড় আঘাত হয়ে আসে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়া। জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় দণ্ড নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগারে যাওয়ার পর জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায়ও তার সাজার রায় হয়।

দুই সাজা নিয়ে বন্দি থাকা অবস্থায় কোভিড মহামারি দেখা দিলে ২০২০ সালের মার্চে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়ে বাসায় থাকতে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

৭৯ বছর বয়সী খালেদা তারপর নানা রোগে ভুগে বাসা-হাসপাতালেই দিন কাটাচ্ছিলেন। বিদেশ যেতে চাইলেও সরকার অনুমতি দেয়নি। ছেলে তারেকও মাকে দেখতে দেশে ফেরেননি।

খালেদা জিয়া ফিরবেন কবে?

গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পর বিএনপির জন্য দৃশ্যপট পাল্টে যায়। খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন রাষ্ট্রপতি। তবে খালেদা তারপরও আদালতে লড়াই চালিয়ে মামলার দায় থেকে মুক্ত হন।

মুক্ত হওয়ার পরও খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় তা কৌতূহল তৈরি করে। কারণ বন্দি থাকা অবস্থায় বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন, আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা আটকে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

চিকিৎসার জন্য গত ৮ জানুয়ারি লন্ডন যান খালেদা জিয়া।

শেষে গত ৭ জানুয়ারি লন্ডন রওনা হন খালেদা জিয়া। বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর জন্য কাতারের আমির রাজকীয় বহরের একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়েছিলেন, তাতে চড়েই যান তিনি।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান দেখা করে আসার পরপরই খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার সিদ্ধান্ত আসায় নানা প্রশ্নও উঠেছিল।

বিএনপিরও কেউ কেউ মনে করছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনের মতো ‘মাইনাস টু’ পরিকল্পনা এখনও সক্রিয় রয়েছে। তাই খালেদা জিয়া দেশ ছাড়তে চাইছিলেন না। যাওয়ার পর দেশে পুনরায় ফেরার নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই লন্ডন রওনা হন তিনি।

লন্ডন যাওয়ার পরপরই মাকে লন্ডন ক্লিনিকে নিয়ে যান তারেক। সেখানে দুই সপ্তাহ তার চিকিৎসা চলে। তার কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা থাকলেও আপাতত তা আর হচ্ছে না বলে জানানো হয়। তারপর ২৪ জানুয়ারি কিংস্টনে তারেকের বাসায় ওঠেন তিনি।

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন লন্ডনে নিয়মিতই সাংবাদিকদের জানিয়ে আসছিলেন।

গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। ছেলে, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতি-নাতনিকে একসঙ্গে পেয়ে তার মনের জোরও বেড়েছে।

খালেদা জিয়া কবে নাগাদ তাহলে দেশে ফিরবেন- সাংবাদিকদের প্রশ্নে ডা. জাহিদ সেদিন বলেছিলেন, “এখনই তা বলা যাচ্ছে না। চিকিৎসকরা যেদিন তাকে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেবেন বা ম্যাডাম মনে করবেন তিনি দেশে যাওয়ার মতো অবস্থায় মধ্যে আছেন তখনই ফিরবেন।”

এরপর গত ৪ মার্চ ডা. জাহিদ বলেন, খালেদা জিয়া আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো আছেন।

হুইল চেয়ারে দেশ ছেড়ে যাওয়া খালেদা জিয়া এখন হাঁটতে পারছেন বলেও খবর আসে।

খালেদা জিয়া দেশে ফিরতে উদগ্রিব হয়ে আছেন, একথা কয়েকবার বলেছেন বিএনপি নেতা জাহিদ। কিন্তু ঠিক কবে তা্র ফেরা হবে, সে বিষয়ে বরাবরই লন্ডনের চিকিৎসকদের সিদ্ধান্তের কথা বলছেন তিনি।

তবে দৈনিক ইত্তেফাক বিএনপির সূত্রের বরাতে খবর দিয়েছে, রোজার ঈদের পর দেশে ফিরতে পারেন খালেদা জিয়া।

এর আগে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেকও এমন কথা বলেছিলেন।

তবে ঈদের পরে ঠিক কখন তিনি ফিরতে পারবেন, সে বিষয়ে বিএনপির কোনো নেতাই নিশ্চিত করে কিছু বলতে চাইছেন না। তারা চিকিৎসকদের কথাই বলছেন।

তারেক কি ফিরবেন এবার?

১৭ বছর ধরে স্ত্রী-েমেয়েকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে থাকা তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে তিনটি অন্তরায় ছিল আলোচনায়। ১, দেশের চারটি মামলায় তার দণ্ড; ২, তার পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা; ৩, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একের পর এক মামলায় খালাস পেতে থাকেন তারেক। তিনি দেশে না থেকেও, কোনো আবেদন না করেও খালাস পেয়ে যান সেই চারটি মামলায়, যেগুলোতে তার দণ্ড হয়েছিল।

প্রথমে দুদকের করা অর্থ পাচারের মামলায় গিয়াস আল মামুনের সঙ্গে তারেকও খালাস পান। এতে হাই কোর্ট তারেককে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেয়।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় তার সাজা স্থগিত হয়ে যায়। জিয়া এতিমখানা দুর্নীতির মামলায়ও আপিল বিভাগের রায়ে মায়ের সঙ্গে তারেকের সাজাও বাতিল হয়েছে।

প্রায় প্রতিদিনই দেশে বিএনপির বিভিন্ন সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন তারেক রহমান।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় তারেকের যাবজ্জীবন সাজার রায় হয়েছিল। রাজনৈতিক পট পরির্তনের পর তারেকসহ সব আসামির সাজাই বাতিল করেছে হাই কোর্ট।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই লন্ডন গিয়েছিলেন বিএনপির কয়েকজন নেতা, তাদের সঙ্গে দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামালও ছিলেন। তারেকের পাসপোর্ট পুনরায় নেওয়ার কাজটি তখন তারা করেছিলেন বলে জানা যায়।

মামলা ও পাসপোর্টের জটিলতার অবসান ঘটলে বাকি থাকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল তারেকের বিরুদ্ধে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়ে কি তারেকের ফেরায় কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে?

উত্তরে বিএনপির কেউ কেউ বলছেন, দৃশ্যমান কোনো বাধা না থাকলেও অদৃশ্য বাধার ইঙ্গিত রয়েছে। তাই পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে দেশে আসতে চাইছেন না তারেক।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর চাপমুক্ত হওয়া বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া যখন বিদেশ যাবেন, তখনই দেশে ফিরবেন তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক।

এরপর মির্জা ফখরুল লন্ডন গিয়ে তারেকের সঙ্গে দেখা করে আসেন । কিন্তু তার ফেরা নিয়ে আর কিছু বলেননি।

গত ডিসেম্বরে তারেকের দেশে ফেরার একটি গুঞ্জন উঠেছিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, “আমি আজকে ডিসেম্বরের প্রথম দিনে একটা সুসংবাদ (২১ আগস্ট মামলা থেকে অব্যাহতি) পেলাম, ইনশাল্লাহ সামনে আরও সুসংবাদ আমরা আশা করছি।”

কিন্তু ডিসেম্বরে তারেকের ফেরা হয়নি। জানুয়ারিতে মা যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর তার চিকিৎসার বন্দোবস্তু করা নিয়ে তিনি ব্যস্ত ছিলেন বলে বিএনপি নেতারা জানান।

কিন্তু ঈদের পর খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার কথা যখন শোনা যাচ্ছে, তখন তারেকের বিষয়ে কোনো কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না।

এনিয়ে সর্বশেষ কথা শোনা গিয়েছিল বিএনপির এখনকার প্রভাবশালী নেতা সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে।

তিনি গত জানুয়ারিতে বলেছিলেন, “এখনো পর্যন্ত তারেক রহমানের দেশে ফেরার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পারিনি। সেজন্য অল্প কিছু সময় লাগবে। তবে তিনি অবশ্যই আসবেন।”

তবে সেই ‘পরিবেশ’ কী, সেই বিষয়ে কখনোই খোলাসা করছেন না বিএনপির কোনো নেতা।

আরও পড়ুন