স্ত্রী ফিরছেন ‘ঝুঁকি নিয়ে’; তারেক রহমানের ফেরার ‘পরিবেশ’ হবে কবে?

লন্ডনে মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক রহমান।
লন্ডনে মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক রহমান।

বিএনপির কর্মীদের মনের আশা পূরণ হচ্ছে না এবারও; লন্ডন থেকে মায়ের সঙ্গে ফিরছেন তা তাদের দলের ভবিষ্যতের কর্ণধার তারেক রহমান।

নিজের চিকিৎসা সেরে ছেলেকে যুক্তরাজ্যে রেখে দুই পুত্রবধূকে নিয়ে খালেদা জিয়া দেশে ফিরছেন আগামী ৫ মে, বিএনপির পক্ষ থেকে এমনটাই জানানো হয়েছে।

তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমান দেশে ফেরার পর তার জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছে বিএনপি।

জোবাইদা রাজনীতিতে জড়িত না হলেও তার নিরাপত্তা চেয়ে দেওয়া সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, তারেকের স্ত্রী হিসেবে তার জীবনের ঝুঁকি রয়েছে।

তারেক রহমান কেন ফিরছেন না এখনও, তা কি এই চিঠি থেকে ধারণা নেওয়া যায়? তবে কি এখনও দেশে ফিরলে তারেকের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে?

তারেকের জন্য যদি তার স্ত্রীর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তাহলে তার জীবনের ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করাই যায়। তাহলে প্রশ্ন উঠবে ঝুঁকিটি কোন দিক থেকে?

বিএনপি কখনও এবিষয়টি খোলাসা করছে না। তাতে দলটির কর্মীদের মধ্যে রয়েছে হতাশা। বৈরী প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সরকারের পতন হলেও  দলটির নেতারা এক কথাই বলে আসছেন, ফেরার ‘পরিবেশ’ হলেিই ফিরবেন তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

তবে সব দণ্ড থেকে খালাস পাওয়া, বিভিন্ন মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া, হারানো পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার পরও তারেকের ফেরা কোথায় আটকে আছে, তা স্পষ্ট হচ্ছে না বিএনপির কর্মীদের কাছে।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তারেক রহমান। তার আগে মা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় প্রশাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হাওয়া ভবনে বসে তিনি সব কিছু চালাতেন বলেই অভিযোগ ওঠে।

গ্রেপ্তার হওয়ার পরের বছর রাজনৈতিক সমঝোতায় মুক্তি পাওয়ার পর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য তারেক লন্ডন চলে যান, তারপর আর ফেরেননি।

গত জানুয়ারিতে শাশুড়ি খালেদা জিয়া লন্ডন পৌঁছনোর পর বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন জোবাইদা রহমান।   

এর মধ্যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চারটি মামলায় তারেকের কারাদণ্ড হয়। তার মধ্যে একটি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলা।

তারেকের চিকিৎসক স্ত্রী জোবাইদা সরকারি চাকরি করতেন। কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার জন্য তাকেও চাকরিচ্যুত করে আওয়ামী লীগ সরকার।

বৈরী অবস্থায় তারেক তার ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পরও দেশে ফেরেননি। মা খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে দণ্ড নিয়ে কারাগারে যাওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলেও দেশে আসেননি তারেক।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মাঝে-মধ্যেই বলতেন, তারেক রহমানের সাহস থাকলে দেশে এসে তার বিরুদ্ধে মামলা মোকাবেলা করুক। তাকে ফেরত আনতে চেষ্টাও চালায় আওয়ামী লীগ সরকার, কিন্তু সফল হয়নি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসন অবসানের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। প্রথমেই কারাগার থেকে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

এরপর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে আদালতও তাকে অব্যাহতি দেয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলাসহ অন্য মামলার দণ্ড থেকে অব্যাহতি পা্ন তারেকও।

আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তারেকের পাসপোর্ট নবায়ন না হওয়ায় তিনি পাসপোর্টহীন ছিলেন। কিন্তু আগস্টের পালাবদলের পর বিএনপি নেতারা লন্ডন গিয়ে তার পাসপোর্ট সমস্যার সুরাহা করে আসেন বলেও জানা যায়।

এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশ যাবেন, তখন তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।

কিন্তু চিকিৎসার জন্য গত ৮ জানুয়ারি খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার পর বলা হয়, মায়ের চিকিৎসার তদারকির জন্যে এখন আসছেন না তারেক।

তখন ধারণা করা হয়েছিল, খালেদা জিয়া যখন চিকিৎসা শেষে ফিরবেন, তখন ছেলেকে নিয়েই ফিরবেন।

কিন্তু বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন দেশের সাংবাদিকদের জানান, ৫ মে খালেদা জিয়া ফিরছেন দেশে, তার সঙ্গে ফিরবেন তার দুই পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান ও শর্মিলা রহমান সিঁথি।

ফেরার সফরসঙ্গীদের যে তালিকা তিনি দেন, তার মধ্যে তারেকের নাম নেই। ফলে এটা নিশ্চিত যে তারেক আপাতত ফিরছেন না।

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তার ৩০ এপ্রিল জোবাইদা রহমানের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ মহাপরিদর্শক বা আইজিপিকে চিঠি দেওয়ার তথ্যটি দুদিন পর শুক্রবার প্রকাশ করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

চিঠিতে বলা হয়েছে, “বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসা শেষে আগামী ৪ মে (যদিও এখন ৫ মে বলা হচ্ছে) দেশে ফিরবেন। জোবাইদা রহমান তার সফরসঙ্গী হিসেবে দেশে আসবেন।”

খালেদা জিয়া গুলশানে তার বাড়িতে থাকলেও জোবাইদা ঢাকার ধানমণ্ডিতে তার পৈত্রিক বাড়িতে উঠবেন জানিয়ে সেখানে এবং তার চলাচলের সময়ও নিরাপত্তার বন্দোবস্তু করতে সেই চিঠিতে অনুরোধ করা হয়।

নৌবাহিনীরি সাবেক প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের মেয়ে জোবাইদা কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তার রাজনীতিতে আসার গুঞ্জন নানা সময়ে উঠলেও তা ঘটেনি।

তারেককে নিয়ে কঠোর কথা বললেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জোবাইদাকে নিয়ে সুর ছিল নরম।  তিনি এমনও বলেছিলেন, জোবাইদা ‘ভালো ঘরের মেয়ে’, চাইলে রাজনীতিতে আসতেই পারে।

তারেকের সঙ্গে দুর্নীতির একটি মামলায় জোবাইদারও সাজা হয়েছিল। তবে পালাবদলের পর তিনিও সেই মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

তাহলে জোবাইদার নিরাপত্তার ঝুঁকি কোথায়? সেই বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, “জিয়া পরিবারের সদস্য ও তারেক রহমানের স্ত্রী হিসেবে তার জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে।

“সে কারণে তার ঢাকার বাসায় অবস্থানের সময় এবং যাতায়াতের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।”

সাড়ে ৭ বছর পর গত জানুয়ারিতে মাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেন তারেক রহমান।

চিঠিতে জোবাইদার জন্য চার ধরনের নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সশস্ত্র ‘গানম্যান’, গাড়িসহ ‘পুলিশ প্রটেকশন’, বাসায় পুলিশি পাহারা এবং বাসায় আর্চওয়ে স্থাপন।

চিঠি দেওয়ার কথা সাত্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করলেও জোবাইদার জন্য বিশেষ নিরাপত্তা চাওয়ার বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আর কিছু বলা হয়নি।

এদিকে তারেকের ফেরা নিয়ে বিএনপির নেতারা এখন কিছুই বলছেন না। তারা আগের মতোই বলছেন, ‘সময় হলেই’ ফিরবেন তাদের নেতা। যদিও বিএনপির প্রতিটি সমাবেশে দলটির কর্মী-সমর্থকরা স্লোগান তুলছেন- “তারেক জিয়া বীরের বেশে, ফিরবে আবার বাংলাদেশে।”

দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারীর সেই ফেরাটা কবে হবে, সেই প্রশ্ন যেমন বিএনপির কর্মীদের মধ্যে রয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনেও তা রয়েছে আলোচনায়।

খালেদা জিয়া বিদেশ যাওয়ার আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ লন্ডন গিয়েছিলেন। তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকও করে আসেন।

দেশে ফেরার পর সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিল এই বিষয়ে, তাতে তারেক রহমানের ফেরার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।

তিনি তখন বলেছিলেন, “তারেক রহমানের দেশে ফেরার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আমরা এখনও সৃষ্টি করতে পারিনি৷ সেজন্য অল্প কিছু সময় লাগবে।”

সেই ‘উপযুক্ত পরিবেশ’ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন, তাও খোলসা করেননি সালাহউদ্দিন।

আইনি কোনো বাধা না থাকলেও রাজনৈতিক দিক থেকে কোনো বাধা রয়েছে কি না, তা নিয়েও তখন অনেকের কৌতূহল ছিল।

তবে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা স্পষ্ট করেন, তাদের দিক থেকে কোনো বাধা নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মূখ্য সংগঠক ও এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ তখন ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেছিলেন, “আমরা কোনো টু-মাইনাস বা থ্রি-মাইনাস থিওরিতে বিশ্বাসী নই৷ তারেক রহমান  চাইলে যে কোনো সময় বাংলাদেশে আসতে পারেন৷ তার মামলাগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় দেখা হচ্ছে৷”

তারেক রহমান বিভিন্ন মামলায় খালাস পেলেও তার বিরুদ্ধে কিছু মামলা এখনও রয়েছে। তা থেকে ধারণা করা যেতে পারে, তারেক রহমান সবগুলো মামলা থেকে মুক্ত হয়েই দেশে ফিরতে চান। অর্থাৎ পুনরায় জেলে যাওয়ার কোনও ঝুঁকি তিনি নিতে চান না।

বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার কায়সার কামাল তখন ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, “তারেক রহমান সাহেবের মামলাগুলো আমরা আইনগতভাবেই মোকাবেলা করছি। তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ৷ দেশে আসার ব্যাপারে তিনি যথাসময়ে পদক্ষেপ নেবেন।”

তবে সেই সময় কবে হবে, তার কোনো ইঙ্গিত না পাওয়ার মধ্যে আবার নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে।

আবার খালেদা জিয়া লন্ডন যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তার সঙ্গে খালেদা জিয়ার কী নিয়ে কথা হয়েছে, তার মধ্যে তারেকের ফেরা-না ফেরার বিষয়টি রয়েছে কি না, তাও জানা যাচ্ছে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

খালেদা গেলেন, তারেক রহমান ফিরবেন কবে?

আরও পড়ুন