চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা নিয়ে ‘রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ গোড়া থেকেই। সর্বশেষ উচ্চ আদালতে জামিন হলেও তা স্থগিতে দৌড়ঝাঁপ দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- তাহলে কি হুমকি-ধমকিতে সীমাবদ্ধ আদালতের ক্ষমতা?
বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতার হুমকির পর এমন সংশয় প্রকট হয়েছে সংখ্যালঘু নেতাদের মনে।
খোদ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে তাদের কাছে মনে হচ্ছে জামিনের বিষয়ে আদালতের খুব বেশি কিছু করার নেই।
গত বুধবার হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময়ের জামিন মঞ্জুর করেন বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ। অবশ্য তা স্থগিত চেয়ে আবেদনের ফলে রোববার আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে তিনি চূড়ান্ত জামিন পাবেন কি না।
একই মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ গত ২ জানুয়ারি চিন্ময়ের জামিন আবেদন খারিজ করে আদেশ দিয়েছিলেন। এ নিয়ে হাইকোর্টে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে গত ১২ জানুয়ারি আবেদনটি করেছিলেন চিন্ময় দাস। এ আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রুল দেন হাই কোর্ট।
ওই রুলে কেন তাকে জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলাটি করেছিলেন।
এ ঘটনার জের ধরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে চিন্ময় কৃষ্ণসহ তার কয়েকজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ
এদিকে চিন্ময় দাসের জামিন পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়েছে ফেইসবুক থেকে সড়কে। জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে স্ট্যাটাস দিয়ে চিন্ময়ের জামিন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, “চিন্ময়ের ঘটনার শুরু থেকেই ভারতীয় আধিপত্যবাদ এ দেশের ওপর অন্যায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। চিন্ময়ের জামিনও কি সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই দেওয়া হলো?”
অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘সাবধান’ করে বলেন, “ইন্টেরিম সাবধান! আলিফের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের রাস্তা উন্মুক্ত করলে পরিণতি ভালো হবে না।”
হাসনাত আব্দুল্লাহর স্ট্যাটাস দেওয়ার পরের দিন শুক্রবার চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন বাতিল ও আইনজীবী আলিফ হত্যার বিচারের দাবিতে চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা।
সমাবেশে তারা বলেন, “আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, চিন্ময় দাসের জামিন বাতিল করে তার বিচার করতে হবে। অন্যথায় আমরা আবার রাজপথে নামব।”
আদালতে হস্তক্ষেপ
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, গত ৯ আগস্ট ৫০ জন বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করা হয় ‘সাধারণ আইনজীবীদের’ ব্যানারে।
১০ আগস্ট ওই সময়ের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগের দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করা হয়। পদত্যাগ না করলে তারা প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিদের বাসভবন ঘেরাওয়েরও হুমকি দেয়।
ওই হুমকির পর ওই দিনই প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয়জন বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন।
এরপর ১২ নভেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী ও দলবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়। ১৩ নভেম্বর সকালেই তারা সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ‘বৈষম্য বিরোধী আইনজীবীরা’।
এই ঘেরাও চলার সময়ই প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে চায়ের দাওয়াত দেন। তাদের মধ্যে ছয় জন পর্যায়ক্রমে দাওয়াতে যান। বাকি ছয় জন সেখানে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।
এঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের মাধ্যমে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তা খুবই দুঃখজনক। বিচার বিভাগকে অন্য সরকারি অফিসের মতো হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। এখন যেটা করা হচ্ছে, এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তো নিশ্চিত হবেই না, উল্টো মুখ থুবড়ে পড়বে।”
সংখ্যালঘু নেতাদের শঙ্কা
বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের একাধিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য সান ২৪। যদিও বেশিরভাগই নাম প্রকাশে অপারগতা ব্যক্ত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিন্দু জাগরণ মঞ্চের একজন নেতা বলেন, “জামিন ঠেকাতে এবার হাসনাত আব্দুল্লাহ মাঠে নেমেছেন। আন্দোলন করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। তারা যেটা বলবে সেটাই হবে। আদালতের খুব বেশি কিছু করার নেই বলে মনে করি। সরকার যদি না চায় তাহলে চিন্ময় দাসের জামিন হবে না।”
আরেক নেতা বলেন, “হিন্দু হলেও তাকে ভারতীয় ট্যাগ দেওয়ার ঘটনা অনেকে বেড়েছে। আওয়ামী লীগের আমলে যেমন জামায়াত-শিবির ট্যাগ দেওয়া হতো, এখন একই কায়দায় হিন্দুদের ভারতীয় দালাল বলা হচ্ছে।
“চিন্ময় কৃষ্ণকেও ভারতীয় দালাল বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। আসলে বাংলাদেশে হিন্দুরা সত্যিই দুর্বল, তাই আমাদের সায়েস্তা করা খুব সহজ।”
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদদের সাবেক সহ-সভাপতি বলেন, “সারাদিন এতো পতাকা অবমাননা হচ্ছে, ফিলিস্তিনির পতাকার নিচে বাংলাদেশের পতাকা লাগানো হচ্ছে, পতাকার উপর নামাজ পড়া হচ্ছে- তখন পতাকা অবমাননা হয় না। কারণ যারা এই কাজটি করছে তারা সংখ্যাগুরু। তাদের অপরাধ আসলে অপরাধ নয়। সব দোষ শুধু সংখ্যালঘুদের।”
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি নাম প্রকাশ না করে বলেন, “ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে হিন্দুদের উপর হামলা চলছে। ধর্মীয় অনুভূতি কি এক পাক্ষিক? মাদারীপুরে মসজিদের দরজা ভেঙে তিন জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো- কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানলো না, এটা কেমন কথা?”
“চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন পাওয়া শুধুমাত্র একটি মামলার বিচার নয়। এটি বিচার বিভাগ, রাজনীতি এবং ধর্মীয় সম্পর্কের আন্তঃসংযোগের একটি বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদালত কীভাবে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা এখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে গোটা জাতি।”
তিনি আরও বলেন, “আগামী ৪ মে চেম্বার আদালতের শুনানির মাধ্যমে বোঝা যাবে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাস মুক্ত হবেন, নাকি রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় চাপ বিচারিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে।”