হোয়াইট হাউজে মার্কিন গ্রেসিডেন্ট ও তার ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ভলোদিমির জেলেনস্কির বিতণ্ডায় প্রতিক্রিয়া এসেছে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। বিশেষকরে ইউরোপের নেতারা পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের।
ইউরোপের বেশিরভাগ নেতা আকারে ইঙ্গিতে জেলেনস্কির পাশে থাকার ঘোষণা দিলেও শুরু থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন ট্রাম্পের পক্ষ।
ট্রাম্পের প্রতি হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও যে বিভেদ দেখা দেবে সেটি সুনিশ্চিত। কারণ এসব ক্ষেত্রে ২৭ দেশের জোটটির সব সদস্যের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে।
ইউরোপ যখন জেলেনস্কিকে নিয়ে এগোনোর কথা বলছেন, তার বিপরীত চিত্র মার্কিন শিবিরে।
মূল্যবান খনিজ নিয়ে চুক্তি ও ভবিষ্যৎ রুশ হামলা ঠেকাতে ট্রাম্পের কাছ থেকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন জেলেনস্কি। অবশ্য রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ ও মার্কিন সহায়তা নিয়ে বিতণ্ডার পর চুক্তি সই ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জেলেনস্কি অসম্মান প্রদর্শন করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প ও ভ্যান্স৷ ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যমেও বলেছেন, জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত নন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের দরজা খোলা।
হোয়াইট হাউজের ওই ঘটনার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জেলেনস্কিকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন।
সিএনএনকে তিনি বলেন, “এভাবে বৈঠক ভেস্তে দিয়ে আমাদের সময় নষ্ট করার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।”
জেলেনস্কি সত্যিই শান্তি চান কীনা এ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রুবিও। শান্তি প্রচেষ্টাকে অবমূল্যায়ন করার মাধ্যমে জেলেনস্কি এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিরাশ করেছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জবাব এসেছে জেলেনস্কির কাছ থেকেও। ফক্স নিউজকে তিনি বলেছেন, খারাপ কিছু করেছেন কিনা সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নয়। তবে সাংবাদিকদের সামনে এমন ঘটনা তিনি প্রত্যাশা করেননি বলে জানিয়েছেন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কালাস প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “আজকে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে মুক্ত বিশ্বের একজন নতুন নেতার প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা আমাদের ইউরোপের উপরে বর্তায়।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা ইউক্রেনের প্রতি আমাদের সমর্থন বৃদ্ধি করবো যাতে তারা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।”
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ এক্স-এ পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, “একটি আক্রমণকারী: রাশিয়া। আক্রমণের মুখে থাকা একটি জাতি: ইউক্রেন।”
ম্যাক্রোঁ তার সঙ্গে যোগ করেন, “যারা শুরু থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতি সম্মান জানান। কারণ তারা তাদের মর্যাদা, স্বাধীনতা, সন্তান ও ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য লড়ছেন।”
ইউক্রেন ও জেলেনস্কির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা, জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস, নির্বাচিনে জয়ী চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কাইর স্টারমার, পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টুস্ক ও স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ।
ওভাল অফিসে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনার পর ট্রাম্প ও জেলেনস্কি দুজনের সঙ্গেই স্টারমার ফোনে কথা বলেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিসহ আন্তর্জাতিক নেতাদের নিয়ে রোববারের সম্মেলনের অপেক্ষায় আছেন স্টারমার।
গত সপ্তাহেই স্টারমার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করেছেন। এর আগে ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি এতদিন ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে গেলেও কট্টর ডানপন্থি রাজনীতিবিদ হিসেবে ট্রাম্পের সাথে তার ভালো সম্পর্ক।
মেলোনি বলেন, “পশ্চিমাদের প্রতিটি বিভাজন আমাদের সবাইকে দুর্বল করবে এবং যারা আমাদের সভ্যতার পতন দেখতে চায় তাদের সুবিধা দেবে।”
ওভাল অফিসের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্কের বাঁক বদলের ইঙ্গিত মিলছে বলে জানিয়েছেন আটলান্টিক কাউন্সিল’স ইউরোপ সেন্টারের সিনিয়র ফেলো রেচেল রিৎজো।
তিনি মনে করেন, মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যৎ কেমন হবে এই বৈঠকের পর ইউরোপীয় নেতাদের তা ভাবাবে।
“বিশেষ করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের ইউরোপ সফরের পর, আমি মনে করি আমেরিকান মিত্র এবং অংশীদাররা, সত্যিই প্রশ্ন তুলছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কেমন অংশীদার।”
তার মতে, এর ফলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হবে যার ফলে মিত্র ও অংশীদাররা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তাকাতে শুরু করবেন।
এতে বৈশ্বিক স্তরে যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হবে বলেও অভিমত দেন রেচেল রিৎজো।
ট্রাম্প ও জেলেনস্কির দূরত্বের কারণে ভবিষ্যতে যুদ্ধ বন্ধে যেকোন চুক্তিতে পৌঁছানো কঠিন হবে বলে মনে করেন রিৎজিও।
এমনকি সমঝোতা প্রক্রিয়ায় ইউরোপ বাদ পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশই হোয়াইট হাউসের ঘটনায় জেলেনস্কির পাশে দাঁড়ালেও হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টোর অরবান মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ নিয়েছেন। রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ অরবান আগে থেকেই ট্রাম্পের মিত্র হিসেবে পরিচিত।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির বিতণ্ডার পর তিনি এক্স-এ লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ সাহসের সঙ্গে শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যদিও তা অনেকের পক্ষে হজম করা কঠিন। ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।”
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির বাগযুদ্ধ, ভেস্তে গেল চুক্তি সই