গ্রিনল্যান্ড আসলে কার?

Greenland

গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ডনাল্ড ট্রাম্পের কথায় কোনো রাখঢাক নেই। তার সোজাসাপ্টা কথা- গ্রিনল্যান্ড কিনতে চান তিনি। বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্নও উঠছে।

ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমে আর উত্তর আমেরিকা ও রাশিয়ার মাঝখানে কৌশলগত অবস্থানে থাকা দ্বীপটিকে কেন ট্রাম্প চাইছেন? এখানে ডেনমার্কেরই বা কী করার আছে? তবে এসব প্রশ্ন ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গ্রিনল্যান্ড আসলে কার? কেনাবেচার বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প কার সাথে কথা বলবেন?

গ্রিনল্যান্ড কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং এর বিশেষত্ব নিয়ে ১০টি চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরা হলো-

> ঐতিহাসিকভাবে গ্রিনল্যান্ড বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের অধীনে ছিল। যদিও প্রাথমিক বসতি স্থাপনকারীরা এখানে পা রেখেছিল বহু শতাব্দী আগে। আর দ্বীপটির মালিকানা দাবির বিষয়টি অল্পকিছু শতাব্দী আগে থেকে হয়ে আসছে।

> ডেনমার্ক এবং নরওয়ে যখন ড্যানো-নরওয়েজিয়ান রাজ্য নামের একটি দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, তখন সেখানকার অভিযাত্রী ও বসতি স্থাপনকারীরা গ্রিনল্যান্ড পৌঁছানোর পর তার সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেছিল। সে সময় দ্বীপটির নাম ছিল ‘কালালিত নুনাত’। এরপর ১৮১৪ সালে আলাদা হওয়ার সময় ডেনমার্ক ও নরওয়ে একমত হয়, গ্রিনল্যান্ড উপনিবেশ থাকবে ডেনিশ রাজের অধীনে।

> ডেনমার্ক জার্মানির নাৎসি বাহিনীর কব্জায় যাওয়ার আগে প্রায় ১৪০ বছর ডেনিশ রাজের অধীনেই ছিল গ্রিনল্যান্ড। ‘অপারেশন ওয়েসেরানবাঙ’ এর মাধ্যমে ১৯৪০ সালের ৯ এপ্রিল ডেনমার্ক ও নরওয়ে আক্রমণ করে জার্মানি। একদিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে ডেনমার্ক, ফলে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গ্রিনল্যান্ডও হিটলারের এলাকায় পরিণত হয়। কিন্তু গ্রিনল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থানের কারণেই দ্রুতই পদক্ষেপ নিতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র এবং হিটলারের বাহিনী পা রাখার আগেই দ্বীপটির দখল নেয়।

> গ্রিনল্যান্ড এরপর যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হয়ে ছিল ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে হিটলারের মৃত্যুর পাঁচ দিন পর ১৯৪৫ সালের ৫ মে জার্মানি থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ডেনমার্ক। কয়েক মাস পর ডেনমার্কের কাছে গ্রিনল্যান্ড ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫৩ সালে দ্বীপটি আনুষ্ঠানিকভাবে ডেনমার্কের অংশ হয়, গ্রিনল্যান্ডের অধিবাসীরা হন ডেনমার্কের নাগরিক।

> কিন্তু নরওয়েজিয়ান সাগরের ৩ হাজার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত বিশাল দ্বীপটির প্রশাসনিক কাজ চালাতে হিমশিম খেতে হয় ডেনমার্ককে। বিষয়টি নিয়ে গ্রিনল্যান্ডের মানুষও খুশি ছিল না। ১৯৭৯ সালের ১ মে দ্বীপের শাসনভারের অনেকটাই বাসিন্দাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ডেনমার্ক। কিন্তু বৈদেশিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিজের হাতে রাখে ডেনমার্ক, যা এখনো আছে। 

> তবে গ্রিনল্যান্ডের ‘ইনাতসিসার্টুট’ নামের নিজস্ব পার্লামেন্ট আছে এবং ডেনিশ পার্লামেন্ট ‘ফোকেটিংয়ে’ তাদের দুজন প্রতিনিধিও আছে। সময়ের সাথে সাথে গ্রিনল্যান্ডবাসী সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করতে শুরু করে। রাশিয়ার সাথে স্নায়ুযুদ্ধ তুঙ্গে থাকার সময় ডেনমার্ক একটি চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে করে গ্রিনল্যান্ডে ‘পিটুফিক’ সামরিক ঘাঁটি, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কমান্ড এবং প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার পর ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ করা শুরু করে এবং ১৯৬৮ সালে চারটি হাইড্রোজেন বোমাসহ একটি মার্কিন সামরিক জেট সেখানে বিধ্বস্তও হয়।

> গ্রিনল্যান্ডে নিজস্ব শাসন শুরু হওয়ার আগে থেকেই অবশ্য ডেনমার্কের সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করেছিল। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে একটি গণ-গর্ভনিরোধক কেলেংকারির ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এজন্য ডেনমার্ককে দায়ী করে সে সময় গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ঘটনাটিকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। 

> আজও গ্রিনল্যান্ড ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। কারণ ডেনমার্ক এখনো দ্বীপটির নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্র নীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এর অর্থ হলো- ডনাল্ড ট্রাম্পের সাথে যেকোনো সম্ভাব্য আলোচনা সরাসরি গ্রিনল্যান্ড নয়, ডেনমার্ক করবে, যা বর্তমান সমীকরণকে জটিল করে তুলতে পারে।

> ডনাল্ড ট্রাম্প সোজাসাপ্টা বলেছেন, গ্রিনল্যান্ডের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন এবং তিনি দ্বীপটির মালিকানা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘খুবই প্রয়োজনীয়’। গ্রিনল্যান্ডের দিকে ট্রাম্পের এবারই প্রথম নজর পড়েছে, বিষয়টি তা না। তিনি নিজেই বলেছেন, ২০১৯ সালেও ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের কাছে দ্বীপটি কেনার উপায় জানতে চেয়েছিলেন, যাকে তিনি বলেছিলেন ‘বৃহৎ রিয়েল এস্টেট চুক্তি’।

> গ্রিনল্যান্ড প্রাকৃতিক সম্পদের দ্বীপ। এখানে রয়েছে তেল ও গ্যাসের মজুদ। এখানকার মাটিতে রয়েছে সবুজ প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় বিরল উপকরণ এবং কাঁচামালের বিশাল মজুদ। চীনও দ্বীপে তার উপস্থিতি বাড়াতেও চাইছে। ওয়াশিংটন যে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিচ্ছে এর মাধ্যমে মূলত সেই পরিস্থিতি এড়াতে চাইছে চীন। কারণ বেইজিং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের রপ্তানির বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, গ্রিনল্যান্ড কিনে নিলে তিনি প্রযুক্তি এবং দুর্লভ উপকরণ রপ্তানিতে বিশ্বে চীনের আধিপত্য থামাতে পারবেন। বিষয়টা তার কাছে এতটাই জরুরি হয়ে দঁড়িয়েছে যে, দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি ব্যবহারের হুমকিও দিয়েছেন।

সূত্র: এনডি টিভি

আরও পড়ুন