পাকিস্তানের ‘অপ্রচলিত যুদ্ধ’ পছন্দ কেন?

india-pak-

পাকিস্তান বরাবরই পছন্দ করে ‘অপ্রচলিত যুদ্ধ’। এটি হলো অ্যাসিমেট্রিক ওয়ারফেয়ার। অর্থাৎ সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নেওয়া। এই ‘অপ্রচলিত যুদ্ধ’ পাকিস্তান শুরু করেছিল জেনারেল জিয়াউল হকের সময় থেকে। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান প্রথম যে যুদ্ধটা লড়েছিল, সেটাও ‘অপ্রচলিত যুদ্ধ’ হিসেবেই শুরু হয়েছিল।

ভারতের সাবেক উপ-সেনাপ্রধান, বর্তমানে দেশের ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডে’র সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুব্রত সাহা পাকিস্তানের এই কৌশলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ২০১৪-২০১৫ সালে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর ১৫ কোরের কমান্ডার ছিলেন। তার সাক্ষাৎকার পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।

১৯৪৭-’৪৮ সালে জম্মু-কাশ্মীরকে ওরা দখল করার ছক কষেছিল ‘পাকিস্তান। সেই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন গুলমার্গ’। এটি ছিল একটা গেরিলা কৌশলই ছিল। পাশতুন জনজাতির লোকজনকে নিয়োগ করে ২০টি লশকর (জনজাতি মিলিশিয়া) তৈরি করেছিল পাকিস্তান। সেই বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় সীমান্ত লঙ্ঘন করে জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে। তার পরে ভারতীয় সেনা অভিযান শুরু করে।

পাকিস্তানের পাঠানো সেই জনজাতি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করতে থাকে। অর্থাৎ, সে বারও পাকিস্তান নিজের সেনাবাহিনীকে সরাসরি যুদ্ধে পাঠাতে পারেনি। জনজাতি বাহিনীর আড়াল নিয়ে মহারাজা হরি সিংহের রাজত্ব দখল করতে চেয়েছিল।

পাকিস্তানের পরিকল্পনা ১৯৪৭-’৪৮ সালে সফল হয়নি। ১৯৬৫ সালেও সফল হয়নি। ১৯৭১ সালে যখন লজ্জাজনক ভাবে হেরে দু’টুকরো হয়ে গেল পাকিস্তান, তখন তারা আরও ভাল ভাবে বুঝে গেল যে, প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘাতে তারা কখনও ভারতের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তাই ‘অপ্রচলিত যুদ্ধ’কেই অভ্যাসে পরিণত করেছে। যেমন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতে হামলা চালাতে পাঠানো। যেমন আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানো। অথবা আচমকা হানাদারি চালিয়ে কখনও সামরিক বাহিনীর ক্ষতি করা, কখনও সাধারণ জনজীবন বিপর্যস্ত করা। কিম্বা সরকারি সেনা বা সীমান্তরক্ষীদের আড়ালে রেখে অন্য কোনও বাহিনী বা সংগঠনকে সামলে এগিয়ে দিয়ে ভারতকে রক্তাক্ত করা। এই সবই হল পাকিস্তান পরিচালিত ভারত-বিরোধী ‘অপ্রচলিত যুদ্ধে’র অঙ্গ।

পেহেলগামে সেই পাকিস্তানি কৌশলেরই শিকার হয়েছে।

প্রত্যক্ষ যুদ্ধে পারবে না জেনেও পাকিস্তান এই ধরনের নাশকতা কেন চালায়, তা বুঝতে গেলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থার বিষয়ে জানতে হবে।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির এই মুহূর্তে নিজের দেশে কোণঠাসা। শাহবাজ শরিফের সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল নয়। পাক সেনাতেও বিভাজন তৈরি হয়েছে। উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বিরাট অংশ জেনারেল মুনিরের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে, তার অপসারণ চাইছে। দেশের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের বাহিনী প্রচণ্ড মার খাচ্ছে। খাইবার-পাখতুনখোয়ায় পরিস্থিতি হাতের বাইরে। তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হচ্ছে। বেলুচিস্তানের বিদ্রোহীদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছে। যে লড়াইয়ের সাম্প্রতিকতম ফলশ্রুতি ‘জাফর এক্সপ্রেস’ হাইজ্যাক হয়ে যাওয়া। যে ট্রেনে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর লোকজনই সবচেয়ে বেশি যাতায়াত করে। পরিস্থিতি এমনই যে, পাকিস্তানের সাধারণ জনমতও জেনারেল মুনিরের বিপক্ষে।

এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব তথা দেশের রাশ নিজের হাতে রাখতে গেলে জেনারেল মুনিরকে এমন কিছু ঘটাতে হত, যা গোটা পাকিস্তানে একটা আবেগের ঢেউ তুলবে। সপ্তাহখানেক আগে জেনারেল মুনির তারই ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। এক ভাষণে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, তারা হিন্দুদের চেয়ে কতটা আলাদা। বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ভারত ভেঙে পাকিস্তান তৈরির নেপথ্যে কত ‘সংগ্রাম’ রয়েছে। তার পর তিনি বলেছিলেন, এ হেন পাকিস্তানকে কী ভাবে রক্ষা করতে হয়, তা তার জানা। জেনারেল মুনিরের ওই ভাষণ সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়। আসলে ওই ভাষণটি ভাইরাল করা হয়, যাতে ভারতে নাশকতা হওয়ার পরে পাকিস্তানের জনতা সে ঘটনার সঙ্গে জেনারেল মুনিরের ভাষণকে সহজে মিলিয়ে ফেলতে পারে।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, যারা ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করার সাহস পায় না, তারা ভারতকে এ ভাবে রক্তাক্ত করার সাহস পায় কী করে? ভারত যদি সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে না-চেয়েও যে প্রত্যক্ষ সংঘাতেই জড়াতে হবে, সে কথা কি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জানেন না? অবশ্যই জানেন। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার বা পাকিস্তানের সেনা যখন এ সব ঘটায়, তখন কিছু পরিস্থিতি বিচার করে ঘটায়। ভারতের পূর্ব সীমান্তে, অর্থাৎ বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা ভারতের পক্ষে খুব একটা অনুকূল নয়। সেই বাস্তবতা সম্ভবত জেনারেল মুনিরের মনোবল কিছুটা বাড়িয়েছে। তিনি সম্ভবত এ-ও ভাবছেন যে, ভারতের বিরুদ্ধে সক্রিয় হলে তিনি চীনের সমর্থন পাবেন। এই সব ধারণার ভিত্তিতে পাক সেনাপ্রধান ভেবেছেন, কোণঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এটাই একমাত্র উপায়।

জেনারেল পারভেজ মুশারফও এ ভাবেই কোণঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে মুশারফ পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে পাকিস্তানে তার জনসমর্থন তলানিতে ঠেকেছিল। তখনই ভারতীয় সংসদে জঙ্গিহানার ঘটনা ঘটল। ২০০১ সালে নয়াদিল্লিতে সেই হামলার পরে ইসলামাবাদে মুশারফের গুরুত্ব আবার বেড়ে গিয়েছিল। জেনারেল মুনির এখন মুশারফের দেখানো পথেই নিজের গদি টিকিয়ে নিতে চাইছেন।

পাকিস্তানকে উপযুক্ত জবাবই দেওয়া হবে। পেহেলগামে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা একেবারেই নিরস্ত্র, নিরীহ, সাধারণ নাগরিক। পাকিস্তানকে জবাবটাও এ বার সেই মাত্রাতেই দেওয়া হবে। এতগুলো যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’তে কখনও কোনও আঁচ পড়েনি। এই প্রথম ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ ভারত স্থগিত করে দিল। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এ বার এমন অনেক কিছু হবে, যা আগে কখনও হয়নি।

যুদ্ধ হলে চীনের সমর্থন পাবেন বলে জেনারেল মুনির যে আশা করছেন, তা-ও দুরাশায় পরিণত হতে পারে। ইতিহাস বলছে, ভারত-পাকিস্তানের কোনও যুদ্ধে চীন এখনও সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। ভারতের কোনও পদক্ষেপ সম্পর্কে চীন তার অসন্তোষ ব্যক্ত করতে পারে। ভারতের কী করা উচিত, কী উচিত নয়, চীন সে সব নিয়ে নানা বিবৃতি দিতে পারে। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।

১৯৭১ সালের যুদ্ধেও চীন ভারতের পক্ষে ছিল না। শুধু চীন নয়, সে সময়ে আমেরিকাও ভারতের পক্ষে ছিল না। বরং আমেরিকা সরাসরি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। পাকিস্তানকে সাহায্য করতে আমেরিকা তাদের সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল কী হয়েছিল, সকলে জানেন। এ বার তো আমেরিকাও ভারতের পক্ষে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, সন্ত্রাস নির্মূল করতে ভারত যে পদক্ষেপই করুক, আমেরিকা তাতে বাধা দেবে না।

আরও পড়ুন