দেশে দেশে কেন বাড়ছে সামরিক ব্যয়

arms

শীতল যুদ্ধের শেষ সময়ের পর থেকে বিশ্ব এখন সবচেয়ে দ্রুতগতিতে অস্ত্র মজুদের দিকে যাচ্ছে। ইউক্রেন ও গাজায় বড় ধরনের যুদ্ধ চলছে। আর ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত সামরিক উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। 

এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় আগের বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৭১৮ ট্রিলিয়ন ডলারে। এটি এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড করা পরিমাণ, জানিয়েছে সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)। 

সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, বিশ্বব্যাপী এই অস্ত্র প্রতিযোগিতার শেষ এখনও চোখে পড়ছে না। এই হারে বৃদ্ধি ১৯৮৮ সালের পর সর্বোচ্চ। 

সিপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক দেশ ভবিষ্যতে তাদের সামরিক বাজেট আরও বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বে সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। ২০২৪ সালে দেশটি প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে সামরিক খাতে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটের বড় অংশ গেছে এফ-৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমান ও এর যুদ্ধ ব্যবস্থায় (৬১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার), নৌবাহিনীর নতুন জাহাজ নির্মাণে (৪৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার), পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার আধুনিকীকরণে (৩৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার) ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় (২৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার)। 

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ৪৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যা ইউক্রেনের নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাজেটের (৬৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার) প্রায় তিন-চতুর্থাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের পরেই রয়েছে চীন। ২০২৪ সালে চীন সামরিক খাতে প্রায় ৩১৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। 

সিপ্রির প্রতিবেদনে চীনের অস্ত্র বা খাতভিত্তিক ব্যয়ের বিশদ দেওয়া হয়নি। তবে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে চীন নতুন স্টিলথ যুদ্ধবিমান, চালকবিহীন আকাশযান (ড্রোন) এবং চালকবিহীন পানির নিচের যান তৈরি করেছে। একই বছর চীন তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার দ্রুতগতিতে বাড়িয়েছে।

ওয়াশিংটন ও বেইজিং মিলিয়ে ২০২৪ সালের মোট বৈশ্বিক সামরিক ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক ব্যয় করেছে।

যেসব দেশ সরাসরি যুদ্ধের মধ্যে আছে বা আঞ্চলিক সংঘর্ষের আশঙ্কায় রয়েছে, তাদের সামরিক ব্যয়ে সবচেয়ে বড় ধরনের বৃদ্ধি দেখা গেছে।

ইসরায়েল ২০২৩ সালে গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান চালিয়েছে। ২০২৪ সালে তাদের সামরিক ব্যয় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। 

২০২৪ সালে ইরানের সামরিক খরচ প্রকৃত হিসাবে ১০ শতাংশ কমে ৭৯০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও ইরান আঞ্চলিক সংঘর্ষে জড়িত এবং আঞ্চলিক সহযোগী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তবুও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ইরানের খরচ বাড়ানোর সক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করে দিয়েছে।

২০২৪ সালে সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম সামরিক ব্যয়কারী দেশ ছিল। দেশটির সামরিক ব্যয় মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে আনুমানিক ৮০৩০ কোটি ডলারে পৌঁছালেও, এটি ২০১৫ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের তেল রাজস্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল।

যুক্তরাজ্য তার সামরিক ব্যয় ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৮১৮০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। এতে দেশটি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সামরিক ব্যয়কারী দেশে পরিণত করে। একই বছর ফ্রান্সের সামরিক ব্যয় ৬ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬৪৭০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। সুইডেন তার সামরিক ব্যয় ৩৪ শতাংশ বাড়িয়ে ১২০০ কোটি ডলারে উন্নীত করে। ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার প্রথম বছরেই সুইডেনের সামরিক ব্যয় দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ০ শতাংশে পৌঁছায়।  

রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা চালায়। তাদের ব্যয় অন্তত ৩৮ শতাংশ বেড়েছে বলে অনুমান। তবে সিপ্রি মনে করে, প্রকৃত বৃদ্ধি আরও বেশি হতে পারে। কারণ রাশিয়া কেন্দ্রীয় বাজেট ছাড়াও বিভিন্ন উৎস থেকে সামরিক খাতে অর্থ যোগাচ্ছে।

তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটো সদস্য দেশগুলোও তাদের সামরিক বাজেট উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয় দেশগুলোকে বেশি দায়িত্ব নিতে বলেন। এই চাপও বাজেট বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে।

বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা বাজেটধারী দেশ জার্মানি ২০২৪ সালে ব্যয় ২৮ শতাংশ বাড়িয়েছে। রোমানিয়া (৪৩%), নেদারল্যান্ডস (৩৫%), সুইডেন (৩৪%), চেক প্রজাতন্ত্র (৩২%), পোল্যান্ড (৩১%), ডেনমার্ক (২০%), নরওয়ে (১৭%), ফিনল্যান্ড (১৬%), তুরস্ক (১২%) ও গ্রিস (১১%) — এসব ন্যাটো সদস্য দেশ সামরিক ব্যয়ে দ্বিগুণ অঙ্কে বাড়িয়েছে।

সিপ্রির গবেষক জ্যাড গুইবারতো রিকার্ড বলেন, “ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্যদের ব্যয়ের এই দ্রুত বৃদ্ধি প্রধানত রাশিয়ার হুমকি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো থেকে দূরে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগের কারণে হয়েছে।”

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু বাজেট বাড়ালেই ইউরোপীয় মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা ছাড়াতে পারবে না। রিকার্ড বলেন, “খরচ বাড়ানো মানেই সামরিক সক্ষমতা বা স্বাধীনতা বাড়বে— এমনটা ভাবা ঠিক নয়। এটি অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া।”

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন ২০২৪ সালে ৭ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়েছে। এটি চীনের টানা ৩০ বছর সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির রেকর্ড, যা সিপ্রির তথ্যভাণ্ডারে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিকতা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের এই সামরিক সম্প্রসারণ তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে প্রভাবিত করেছে। ফলে এসব দেশও তাদের সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে।

জাপান ২০২৪ সালে ২১ শতাংশ সামরিক বাজেট বাড়িয়েছে। এটি ১৯৫২ সালের পর দেশটির সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। এর ফলে ২০২৪ সালে জাপানের সামরিক বাজেট দেশটির মোট জাতীয় উৎপাদনের ১ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে, যা ১৯৫৮ সালের পর সর্বোচ্চ।

দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো ফিলিপাইন ১৯ শতাংশ সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে।

সিপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সামরিক খাতে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয় বাড়ালেও, দেশটির সামরিক ব্যয়ের বোঝা পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। সিউলের সামরিক ব্যয় দেশটির মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৬ শতাংশ।

তাইওয়ানে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বসবাস করে। অঞ্চলটি নিজেকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচালনা করলেও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একে নিজেদের অংশ দাবি করে এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে দখল করার হুমকি দিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের তুলনায় তাইপের সামরিক বাজেট মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে ২০১৫ সালের পর থেকে দেশটির সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৪৮ শতাংশ।

ভারত ২০২৪ সালে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম প্রতিরক্ষা বাজেটধারী দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। সে বছর দেশটির সামরিক বাজেট ছিল ৮৬ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের তুলনায় এই বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে গত এক দশকে ভারতের সামরিক খাতে ব্যয় বেড়েছে ৪২ শতাংশ। গবেষকরা এই প্রবণতাকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন।

সিপ্রির সামরিক ব্যয় ও অস্ত্র উৎপাদন কর্মসূচির পরিচালক নান তিয়েন বলেন, “এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বড় বড় সামরিক ব্যয়কারী দেশগুলো এখন উন্নত সামরিক প্রযুক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। এ অঞ্চলে বহু পুরনো বিরোধ ও বাড়তে থাকা উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যয় একটি বিপজ্জনক অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।”

এশিয়ার আরেকটি দেশ মিয়ানমার। সেখানে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ চলছে। দেশটি ২০২৪ সালে সামরিক ব্যয় ৬৬ শতাংশ বাড়িয়েছে। দেশটির সামরিক ব্যয় বর্তমানে জিডিপির ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এই হিসেবে মিয়ানমার এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সবচেয়ে বড় সামরিক বোঝা বহনকারী দেশ।

২০২৪ সালে আফ্রিকা মহাদেশে সামগ্রিক সামরিক ব্যয় ৩ শতাংশ বেড়েছে। আলজেরিয়া এই মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে এবং বৈশ্বিকভাবে ২০তম অবস্থানে রয়েছে।

আমেরিকা মহাদেশে ২০২৪ সালে মেক্সিকোর সামরিক ব্যয় ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। সিপ্রি বলেছে, মেক্সিকোর এই ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে সংগঠিত অপরাধ মোকাবেলায় সরকারের ক্রমবর্ধমান সামরিক পদক্ষেপ।

২০২৪ সালে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ তাদের সামরিক খরচ বৃদ্ধি করেছে। সিপ্রির সামরিক ব্যয় ও অস্ত্র উৎপাদন কর্মসূচির গবেষক জিয়াও লিয়াং বলেছেন, “সরকারগুলো যখন সামরিক নিরাপত্তাকে অধিক গুরুত্ব দেয়, প্রায়শই অন্যান্য খাতের বাজেট কমিয়ে দেয়। তখন এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ভবিষ্যতে সমাজের ওপর গুরুতর পরিণতি বয়ে আনতে পারে।”

আরও পড়ুন