স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার পরও বলকানে ফের কেন ভাঙনের শঙ্কা 

serbia

আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হলেও রিপাবলিকা সার্পস্কার প্রেসিডেন্ট মিলোরাদ দোডিককে মস্কো আসা-যাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারেনি। মার্চের শেষের দিকে বসনিয়ার যুদ্ধ-পরবর্তী চুক্তির বিরোধিতা করায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তখন তিনি এর কিছুদিনের মধ্যেই রুশ রাজধানীতে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রওনা হন।

মাত্র এক মাস পর, তিনি আবার মস্কো যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে অংশ নেন সোভিয়েত ইউনিয়নের নাৎসিদের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উদযাপনে।

ক্রেমলিন বহুদিন ধরে ইউরোপের প্রান্তে রুশপন্থী মনোভাবাপন্ন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের নিয়ে একটি জোট গঠনের চেষ্টা করে আসছে। দোডিককে কাছে টানার এই কৌশল থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, বসনিয়ার যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন দশক পরও কেন ইউরোপীয় কর্মকর্তারা আবারও এই ছোট, অথচ জাতিগতভাবে বিভক্ত রাষ্ট্রটির দিকে গভীরভাবে নজর দিচ্ছেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছেন, সেখানে আবারও বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

ওই অঞ্চলের একজন জ্যেষ্ঠ পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, “গত ৩০ বছরের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট। এটি এখনও নিরাপত্তা সংকটে পরিণত না হলেও পরিস্থিতি খুবই গুরুতর। কারণ এই সংকট হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। বসনিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো দোডিক।”

১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে বসনিয়া ভয়াবহ এক গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এটিই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত। সাবেক যুগোস্লাভ প্রজাতন্ত্রটি জাতিগত রাজনীতির কারণে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। 

ওই যুদ্ধে এক লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। তাদের বেশিরভাগই ছিল বসনিয়ান মুসলিম। সে সময় তারা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৪ শতাংশ ছিল। বসনিয়ান সার্বরা ছিল প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, আর বাকিরা ছিল বসনিয়ান ক্রোয়াট।

যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ডেটন শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তির মাধ্যমে বসনিয়া একটি জোড়াতালি দেওয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর মধ্যে রয়েছে দুটি স্বায়ত্তশাসিত অংশ। একদিকে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ফেডারেশন। সেখানে মূলত বসনিয়ান মুসলিম ও ক্রোয়াটরা বসবাস করে। অন্যদিকে রয়েছে রিপাবলিকা সার্পস্কা (আরএস), যা মূলত বসনিয়ান সার্ব অধ্যুষিত এলাকা। এই অংশেরই বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিলোরাদ দোডিক।

কিন্তু শান্তিচুক্তির পরও বসনিয়ার রাজনীতি এক সংকট থেকে আরেক সংকটে হোঁচট খেয়েছে। জাতিগত বিভাজন এখনও বিদ্যমান। ডেটন চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে, এখন সন্দেহ অনেক কর্মকর্তা ও কূটনীতিকের। 

এই নাটকীয় পরিস্থিতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ৬৬ বছর বয়সী দোডিক। তিনি নির্লজ্জভাবে গত তিন দশক ধরে বসনিয়ায় স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছেন। তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যা তার অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতার পথ খুলে দিতে পারে।

পশ্চিমা কর্মকর্তারা ভয় পাচ্ছেন, রাশিয়া এই উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপের গা ঘেঁষা অঞ্চলে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তারা মনে করছেন, দোডিককে থামানো না গেলে বসনিয়া নতুন করে অস্থিরতার মুখে পড়বে।

পশ্চিমা একজন কূটনীতিক বলেন, “দোডিক জয়ী হলে প্রমাণ হবে যে, বসনিয়ান রাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষক আসলে কতটা দুর্বল। রাশিয়ানদের জন্য এখানে একটি সস্তা বাটন রয়েছে—তারা চাইলেই তা চেপে বসনিয়াকে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করতে পারে।”

১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে স্রেব্রেনিৎসায় হওয়া গণহত্যার ৩০তম বার্ষিকী সামনে আসায় এই পরিস্থিতি আরও অন্ধকার হয়ে উঠেছে। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে জাতিসংঘ স্বীকৃত প্রথম গণহত্যা।

রিপাবলিকা সার্পস্কার সংসদের একজন বিরোধী রাজনীতিক ইগর ক্রনাডাক বলেন, “বসনিয়া এখন একটি মোড় ঘোরার অবস্থানে দাঁড়িয়ে। দোডিককে মস্কো ব্যবহার করছে। তার শাসন অনেক ক্ষতি করেছে। এখন পরিবর্তনের জন্য এটি একটি সুযোগ। এখন নির্ধারণ হবে বসনিয়া কি পশ্চিমের দিকে চূড়ান্তভাবে ঝুঁকবে, নাকি আরএস পুরোপুরি একনায়কতন্ত্রে পরিণত হবে।”

আলমাসা সালিহোভিচ জানেন, বসনিয়ায় কী ভয়াবহ পরিস্থিতি এখনো রয়ে গেছে।

চার বছর আগে তিনি ছিলেন পূর্ব বসনিয়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। একদিন তার মোবাইলে একটি অজানা নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনের ওপারে থাকা ব্যক্তি সরাসরি প্রশ্ন করেন, “আপনি কি আবদুল্লাহর বোন?” তিনি তখনই বুঝে যান বিষয়টি গুরুতর। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, “আপনার সঙ্গে দু’টি উরুর হাড়ের ডিএনএ মিলেছে।”

আলমাসা সত্যিই আবদুল্লাহর বোন। তিনি শেষবার তার ভাইকে দেখেছিলেন ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই স্রেব্রেনিৎসা শহরে। ১৯৯২ সাল থেকে শহরটি বসনিয়ান মুসলিমদের একটি অবরুদ্ধ এলাকা ছিল। বসনিয়ান সার্ব বাহিনী ঘিরে রেখেছিল অঞ্চলটি।

প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে আক্রমণকারীরা শহরটি দখল করে নেয়। আবদুল্লাহ তখন ১৮ বছরের তরুণ। তাকে আরও আট হাজারের বেশি মুসলিম পুরুষ ও কিশোরের সঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর তাদের মরদেহ গোপনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গণকবরে চাপা দেওয়া হয়।

১৩ বছর ধরে ভাইয়ের ভাগ্য সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাওয়ার পর ২০০৮ সালে আলমাসা জানতে পারেন, একটি গণকবর থেকে তার ভাইয়ের কিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে। এরপর ২০২১ সালে আরও একটি ফোন আসে—বলা হয়, তার ভাইয়ের আরও কিছু দেহাবশেষ পাওয়া গেছে।

আলমাসা বলেন, “আমার ভাই মারা গেছে, তার দেহ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা কবর থাকাও অনেকটা সান্ত্বনার মতো। কবর না থাকলে তো শোকেরও জায়গা থাকত না। যখন আমরা তার হাফপ্যান্টের ছোট একটা টুকরো দেখলাম, সেটা এমন কষ্টের ছিল যেন কিছুই না পাওয়ার চেয়ে বেশি বেদনার।”

আলমাসা এখন স্রেব্রেনিৎসা স্মৃতি কেন্দ্রের একজন কর্মী। ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে এই জায়গাটিই ছিল জাতিসংঘের একটি ঘাঁটি। সেখানে বহু শরণার্থী আশ্রয় চেয়েছিল বসনিয়ান সার্ব বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছিল।

এই স্মৃতি কেন্দ্রের পাশেই রয়েছে এক বিশাল ঘাসের মাঠ। যতদূর চোখ যায়, সেখানে ছড়িয়ে আছে ৬ হাজারের বেশি কবরের ফলক। তাদের দেহাবশেষ (কখনও হয়তো একটুকরো হাড় মাত্র) শনাক্ত করে এখানে সমাহিত করা হয়েছে।

স্রেব্রেনিৎসার এই গণহত্যা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করে। তিন বছর ধরে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যর্থ হস্তক্ষেপের পর, যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় হয় যুদ্ধ থামাতে।

ন্যাটোর নেতৃত্বে একটি বোমা হামলা চালানো হয়। এতে বসনিয়ান সার্বদের পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর তারা বসনিয়ান মুসলিমদের দখলে থাকা শহরগুলোর অবরোধ প্রত্যাহারে রাজি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ডেটনে আলোচনার টেবিলে বসে।

সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক রিচার্ড হোলব্রুক বসনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও তাদের সমর্থিত পক্ষগুলোকে বাধ্য করেন একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে।

তবে আলমাসা আশঙ্কা করছেন, যুদ্ধ-পরবর্তী প্রথম এক দশকে স্রেব্রেনিৎসার নির্মম সত্য যে পরিমাণ স্বীকৃতি পেয়েছিল, এখন যেন আবার সেই সত্য অস্বীকার করার প্রবণতা বাড়ছে।

তিনি এখনও বসনিয়ান সার্ব অধ্যুষিত রিপাবলিকা সার্পস্কার অংশ স্রেব্রেনিৎসা শহরে বাস করেন। প্রতিদিন তাকে এমন অনেক সার্বের মুখোমুখি হতে হয়, যারা গণহত্যার ঘটনাকে অস্বীকার করেন বা তুচ্ছ করে দেখান।

তিনি বলেন, “সবসময় এক কথা শুনি, ‘সারা দুনিয়া সার্ব জাতির বিরুদ্ধে।’ গত দুই বছরে আমি খুব ভয় পাচ্ছি, মানুষ কী সহজেই রাজনীতিবিদদের প্রতারণায় পড়ে। রাজনীতিকরা পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে আবার জাতীয়তাবাদের আগুন জ্বালাতে চাচ্ছে।”

গত দুই দশকে রিপাবলিকা সার্পস্কার রাজনীতিতে কেউই সম্ভবত দোডিকের মতো এত দৃশ্যমানভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করেননি।

প্রথম দিকে পশ্চিমা দেশগুলো তাকে এক উদারপন্থী নেতা হিসেবে দেখত। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডলিন অলব্রাইট তাকে বলেছিলেন, “একঝলক সতেজ বাতাস”।

কিন্তু গত দেড় দশকে দোডিক ক্রমাগত সার্ব জাতীয়তাবাদ উসকে দিতে থাকেন। তার ঘনিষ্ঠ মিত্র সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার ভুসিচের সঙ্গে মিলে তিনি জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবনা বিরোধিতা করেন। ওই প্রস্তাবে জুলাই ১১ তারিখকে স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

এই প্রস্তাবকে ঘিরেই তারা দাবি করেন, সার্বদের নিগৃহীত করা হচ্ছে।

দোডিকের সর্বশেষ উত্তেজনা ছড়ানোর কাজ হলো কেন্দ্রীয় সরকার ও ডেটন চুক্তির অধীনে নিযুক্ত উচ্চ প্রতিনিধির (একজন পশ্চিমা প্রশাসক) কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সারায়েভোর একটি আদালত তাকে এক বছরের কারাদণ্ড এবং ছয় বছরের জন্য রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু দোডিক ওই রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছেন।

প্রধান প্রশ্ন হলো, কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কি এই রায় কার্যকর করতে যাবে? গেলে তা কি রেপাবলিকা সার্পস্কার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে গড়াবে?

দোডিক সবসময় সশস্ত্র মিলিশিয়া নিয়ে চলাফেরা করেন। তারা এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয় পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি উত্তেজনার মধ্যে জড়িয়েছিল।

জার্মানির সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমানে ডেটন চুক্তির অধীনে নিযুক্ত উচ্চ প্রতিনিধি ক্রিশ্চিয়ান শ্মিট বলেন, তিনি এই রায় বলপ্রয়োগে কার্যকর করতে একটু সংযত আচরণ করতে চান। তিনি মনে করেন, দোডিককে ব্যালট বাক্সে হারানোই ভালো উপায়।

তার ভাষায়, “এই সংকট গুরুতর, তবে সমাধানযোগ্য।” তার স্বপ্ন হলো, বসনিয়াকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, যাতে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এরপর তিনি এই অঞ্চলের শেষ উচ্চ প্রতিনিধি হিসেবে বিদায় নিতে চান। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য বসনিয়াকে যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করতে হবে, তার মধ্যে এই উচ্চ প্রতিনিধি পদের ধীরে ধীরে বিলুপ্তি অন্যতম। জনমত জরিপ বলছে, বসনিয়ার বেশিরভাগ মানুষই চায় দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হোক।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার অভিযানের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলীয় সম্প্রসারণ পরিকল্পনা আবারও গতি পেয়েছে। এর আগে বহু বছর ধরে পশ্চিম বালকানের ছয়টি দেশের আবেদন (এর মধ্যে বসনিয়াও ছিল) অনিশ্চয়তায় আটকে ছিল।

তবে উচ্চ প্রতিনিধি ক্রিশ্চিয়ান শ্মিট স্বীকার করেন, যতই ত্রুটি থাকুক না কেন, ডেটনের রাজনৈতিক কাঠামো আপাতত চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, বসনিয়ার এখনও অনেক কিছু করার বাকি আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য।

তিনি হাসতে হাসতে বলেন, “অনেক অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষক আমাকে বলেন, আমি সত্যিই শেষ উচ্চ প্রতিনিধি হতে চাইলে আরও ২০ বছর ধরে এই কাজ করতে হবে।”

বসনিয়ান সার্বদের একজন শীর্ষ বিরোধীদলীয় রাজনীতিক এমলাদেন ইভানিচ মনে করেন, বসনিয়ার জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত আশা হলো, ফ্রান্সের প্রস্তাবিত দুটি স্তরের ইউরোপীয় সদস্যপদ ব্যবস্থা। এতে বালকান অঞ্চলের দেশগুলো ধীরে ধীরে কিছু দায়িত্ব ও সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে।

তিনি বলেন, ব্রাসেলস ও সারায়েভোর কর্মকর্তারা প্রায়ই পুরোপুরি সদস্যপদের আশ্বাস দেন। কিন্তু তা অনেকাংশে বাস্তব নয়। 

ইভানিচ বলেন, “ইউরোপ আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দেয়। আমরাও তাদের ভুল বুঝিয়ে রাখি। তারা বলে, দরজা খোলা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই দরজা এখনও বহু বছর পর্যন্ত অধরাই থাকবে।”

ডেটন চুক্তিতে যত সমস্যা থাকুক, এই ব্যবস্থাই অন্তত শান্তি বজায় রাখতে পেরেছে বলে মন্তব্য করেন সারায়েভো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক নেদজমা জানানোভিচ। 

তিনি বলেন, “মানুষ খুব সহজেই ভুলে যায় এই চুক্তির সাফল্য। এমনকি দোডিকও বুঝে গেছেন, কিছু জিনিস আর ঘটতে দেওয়া উচিত নয়।”

তবে তিনি আশঙ্কা করেন, দোডিক তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য পার পেয়ে যাচ্ছেন। 

তিনি বলেন, “আমরা ধীরে ধীরে দেশের চূড়ান্ত বিভাজনকেই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিচ্ছি। দোডিক জাতীয় মুদ্রা ও করের অর্থ গ্রহণ করেন। কিন্তু বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বই আরএস-এ নেই।”

যুদ্ধ-পরবর্তী এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বসনিয়া অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন ইউরোপীয় কর্মকর্তারা আবারও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

এই বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সেনা সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। যদিও দোডিকের মিত্র হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি সম্মিলিত উদ্যোগে বাধা দিয়েছেন। তবুও ওই অঞ্চলে নেতৃত্ব দেওয়া কিছু সদস্য দেশ ও যুক্তরাজ্য দোডিকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

পশ্চিমা কর্মকর্তারা আশা করছেন, দোডিকের পরিবর্তে আরও মধ্যপন্থী বসনিয়ান সার্ব নেতারা উঠে আসবেন এবং একটি সমন্বিত ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তুলবেন। তবে একই সময়ে বসনিয়ান ক্রোয়াট নেতারাও আরও বেশি স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছেন। এতে করে ডেটন চুক্তির ভিত্তি এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে, কেউ কেউ বলছেন, এটি কার্যত অকার্যকর।

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বড় হওয়া তরুণরা, বিশেষ করে রাজধানী সারায়েভোর আধুনিক ও ক্যাফে-সংস্কৃতিতে অভ্যস্তদের কাছে এই অচলাবস্থা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। রাজনৈতিক দুর্নীতিও বিরক্তির আরেকটি বড় কারণ। দুর্নীতির ধারণা সূচকে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা এখন বেলারুশের সঙ্গে একই কাতারে অবস্থান করছে। এই বছর তারা ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ স্কোর পেয়েছে।

এই অবস্থায় দেশ থেকে তরুণরা দ্রুত হারে দেশত্যাগ করছে। ২০০২ সালে দেশটির যুদ্ধ-পরবর্তী জনসংখ্যা ছিল ৪০ লাখ ২০ হাজার। এখন সেটি কমে ৩০ লাখের কিছু বেশি।

দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনের সমন্বয়কারী গর্ডানা মিলাদিনোভিচ। তিনি যুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ সারায়েভোতে বড় হয়েছেন। তিনি বলেন, “দুর্নীতি সমাজে এত গভীরভাবে ঢুকে গেছে যে এখনও আমাকে অবাক করে। এটা যেন সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে গেছে। ফলে সমাজ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সবই ভেঙে পড়ছে।”

তিনি আরও বলেন, “এর সঙ্গে যদি বিচারহীনতার পরিবেশ যোগ হয়, তাহলে বোঝা যায়, যে যত অপরাধী, তার পার পাওয়ার সুযোগ তত বেশি। অনেক মানুষ রাজনীতিতে আসে শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্য।”

তিনি মনে করেন, ডেটন-পরবর্তী কাঠামো এতটাই জটিল এবং বহুস্তরবিশিষ্ট যে, এটি মূলত দুর্নীতির জন্যই তৈরি হয়েছে। দুটি স্বায়ত্তশাসিত অংশ একাধিক ক্যান্টনের জটিল নকশা নিয়ন্ত্রণ করে। আর এর মানচিত্র দেখতে কালি ছিটানো কাগজের মতো লাগে।

বসনিয়ান ক্রোয়াট শিক্ষাবিদ ফ্রাঞ্জো টপিচ দীর্ঘদিন ধরে সারায়েভোতে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করছেন। তিনি মনে করেন, সমস্যার সমাধান হলো—এই দুটি অঞ্চলিক কাঠামো বিলুপ্ত করে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গঠন করা। 

তিনি বলেন, “এই অঞ্চলভিত্তিক কাঠামো যুদ্ধ থামাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখন আমাদের ‘ডেটন টু’ দরকার, যাতে রাষ্ট্রটি কার্যকরভাবে পরিচালিত হতে পারে। বর্তমানে এই অঞ্চলগুলো দুইটি ছোট্ট রাষ্ট্রের মতোই চলছে, যা মোটেও স্থায়ী সমাধান নয়।”

তবে গর্ডানা মিলাদিনোভিচ মনে করেন, এত বেশি স্বার্থ জড়িত রয়েছে যে এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনও বাস্তব সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, “ডেটনে মৌলিক সংস্কার আনা প্রায় অসম্ভব।”

রিপাবলিকা সার্পস্কার এই নিস্তেজ রাজধানী বানিয়া লুকার প্রধান সড়কে একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ঠিক পাশেই ক্যাফের প্রবেশপথে ভ্লাদিমির পুতিনের বিশাল এক প্রতিকৃতি ঝুলে আছে।

এটি হলো ‘পুতিন ক্যাফে’। সেখানে রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের গম্ভীর মুখের ছবি দেখা যায় মেনু কার্ডের উপর, এমনকি ফ্রিজের দরজাগুলোর গায়েও।

এই দৃশ্যপট আসলে এমন একটি বার্তা বহন করে, যা দোডিক ও পুতিন দু’জনেই ছড়িয়ে দিতে চান। তারা একটি জোট গঠনের ভাবমূর্তি তৈরি করছেন। যেখানে রাশিয়ান ও সার্বদের অভিন্ন স্লাভ জাতিসত্তা ও অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

তবে দোডিকের বিরোধীরা মনে করেন, রাশিয়ার এই সমর্থন প্রতীকী মাত্র, বাস্তব নয়।

বসনিয়ান সার্ব বিরোধীদলীয় নেতা এমলাদেন ইভানিচ বলেন, “রাশিয়া বসনিয়াকে নিয়ে ভাবার মতো সময়ই পায় না। তাদের নিজেদের আশেপাশে অনেক সমস্যা। তারা এখানে কী বিনিয়োগ করেছে? প্রায় কিছুই না। আমি কখনও দীর্ঘমেয়াদি কোনও কৌশলগত পরিকল্পনা এখানে দেখিনি।”

দোডিক অবশ্য তার বিচ্ছিন্নতাবাদী উদ্দেশ্যের কথা অস্বীকার করেন। গত মাসে ইউরোনিউজ সার্বিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আপনি আমার কোনও কর্মকাণ্ডে এমন কিছু খুঁজে পাবেন না, যা বিচ্ছিন্নতার দিকে যাচ্ছে। এমনকি আমার একটি কথাও পাবেন না, যা সেদিকেই ইঙ্গিত করে।”

তবে শুক্রবার এক বিরল ঘটনায় তিনি আদালতে হাজির হন। এরপর বসনিয়ার প্রসিকিউটর অফিস তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেয়।

তবুও বানিয়া লুকা ও সারায়েভোর বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, দোডিক হয়তো পশ্চিম বলকানে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার মতো একটি বাস্তবতা গড়ে তুলতে চাইছেন। ট্রান্সনিস্ট্রিয়া হলো মলডোভায় অবস্থিত মস্কো-সমর্থিত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী এলাকা।

দুই বছর আগে দোডিক রিপাবলিকা সার্পস্কার পার্লামেন্টে একটি বিতর্কিত আইন পাশ করান। এর ফলে তিনি আর বসনিয়ার কেন্দ্রীয় সংবিধানিক আদালতকে স্বীকৃতি দেন না। এখন তিনি একটি নতুন আরএস সংবিধান খসড়ার ওপর গণভোট আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন, যার ধারাগুলো কার্যত বিচ্ছিন্নতারই নামান্তর।

এরই মধ্যে তিনি আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি তিনি এমন আইন পাশ করিয়েছেন, যা নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের কার্যক্রম সীমিত করতে পারে। এটি হাঙ্গেরির অরবান ও রাশিয়ার পুতিনের শাসনের কৌশলের অনুরূপ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বানিয়া লুকা কার্যালয়ের প্রধান ইভানা কোরাইলিচ বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ভেঙে পড়ছে। আপনি যদি আইনের শাসনের দিকে তাকান, তবে ২০ বছর আগেও আমাদের অবস্থান অনেক শক্ত ছিল। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ও চাপ কমে গেছে। আর স্থানীয় অভিজাত গোষ্ঠী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক নেটওয়ার্ক সব দখল করে নিয়েছে। আমরা সারাক্ষণই কোনও না কোনও সংকটে থাকি, হোক তা সাংবিধানিক, নাকি নিরাপত্তা-সম্পর্কিত। আর প্রত্যেকবার দোডিক আরেক ধাপ এগিয়ে যান, যেন সবাই তাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে।”

এই সপ্তাহেই স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার ৩০তম বার্ষিকী পালিত হবে। পশ্চিমা কর্মকর্তারা শোকাহত বার্তা দেবেন। কিন্তু তারা যতই দোডিককে মোকাবিলায় মনোযোগ দিন, বেশিরভাগ বসনিয়ান নাগরিক মনে করেন, এই সংকট কেবল দিন দিন আরও গভীর হবে।

সারায়েভোর রাজনীতি অধ্যাপক জানানোভিচ বলেন, “কেউই সাহস করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে না। যতক্ষণ না তার পরিবার ও সম্পদ নিরাপদ থাকবে, ততক্ষণ সে এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে নিয়ে যাবে। সরকার কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুললে দোডিক ও তার পরিবার প্রথমে হাঙ্গেরিতে আশ্রয় চাইবে। আর শেষ বিকল্প হিসেবে তারা মস্কোর শরণাপন্ন হবে।”

তবে তিনি যোগ করেন, “সম্ভবত সে এখানেই থেকে যাবে। তার পালানোর কোনও কারণই নেই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads