২০১৯ সালে রক্ত ঝরার মধ্যে দিয়ে তাবলীগ জামাতের যে বিভক্তি প্রকাশ্যে এসেছিল, তার সবশেষ ঘটনা দেখল বাংলাদেশের মানুষ।
তাবলীগের জুবায়েপন্থি ও সাদপন্থিদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে চার জনের প্রাণহানি ঘটল আবারও।
মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা মাঠ দখল রাখাকে কেন্দ্র করে তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ইজতেমা মাঠের নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি টঙ্গী এলাকায় সব ধরনের সমভা-সমাবেশ, জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু এক সময় যে গোষ্ঠীটির এক ধরনের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ছিল, তারাই কেন এমন বিবাদে জড়াচ্ছেন বারবার?
সবশেষ প্রাণহানির ঘটনায় সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
তাবলীগ জামাতের এই দ্বন্দ্বের উৎসব খুঁজতে যেতে হবে একটু পেছনে, যার কেন্দ্রে রয়েছে নেতৃত্ব।
উপমহাদেশে সুন্নী মতাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় সংঘ তাবলীগ জামাতের মূলকেন্দ্র ভারতের দিল্লিতে।
জুবায়েরপন্থিদের বিরোধী হিসেবে পরিচিত মাওলানা সাদ কান্ধলভির দাদা ইসলামি পণ্ডিত ইলিয়াস কান্ধলভির হাত ধরে ১৯২০ এর দশকে সূচনা হয় তাবলীগ জামাত নামের সংস্কারবাদী আন্দোলনের।
মাওলানা ইলিয়াসের মৃত্যুর পর তার ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ এবং তারপর মাওলানা ইনামুল হাসান এই আন্দোলনের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা ইনামুলের মৃত্যুর পর একক আমিরের বদলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দেওয়া হয় একটি শুরা কমিটিকে।
মাওলানা জুবায়েরের মৃত্যুর পর মাওলানা সাদ আমিরের দায়িত্ব নেন এবং একক নেতৃত্বের নিয়ম ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু মাওলানা জুবায়েরের ছেলে মাওলানা জুহাইরুল হাসান তখন নেতৃত্বের দাবি নিয়ে সামনে আসেন এবং তার সমর্থকরা নতুন করে শুরা কমিটি গঠনের দাবি জানান। কিন্তু সাদ তা প্রত্যাখ্যান করলে বিরোধ বড় আকার ধারণ করে।
নেতৃত্ব নিয়ে দিল্লির মারকাজ এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারীদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করে।
দুই পক্ষের কোন্দলের কারণে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব স্থগিত করা হয়। কিন্তু তার মধ্যেই সাদপন্থিরা ডিসেম্বরের শুরুতে পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা করার ঘোষণা দিলে দেওবন্দপন্থিরা টঙ্গীর ইতজেমা মাঠ দখল করে পাহারা বসায়।
১ ডিসেম্বর ভোর থেকে সাদের শত শত অনুসারী টঙ্গীর পথে রওনা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে প্রাণ যায় সত্তর বছর বয়সী এক বৃদ্ধের। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ।
দ্বিতীয় পর্বের আয়োজনকারীরা একই দিন বিকালে কমিটির কাছ থেকে ইজতেমার মাঠ বুঝে নেবেন। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শেষে ১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তারা কমিটির কাছে মাঠ হস্তান্তর করবেন।
তবে সম্প্রতি তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের জেরে তাদের মধ্যে চলমান বিবাদ নতুন রূপ পায়।
গত ৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘ওলামা-মাশায়েখদের ইসলামি মহাসম্মেলন’ থেকে সাদপন্থিদের নিষিদ্ধ করাসহ ৯ দফা দাবি জানান জুবায়েরপন্থিরা, যারা নিজেদের ‘শুরায়ে নিজাম’ পরিচয় দিয়ে থাকেন।
এরপর ১২ নভেম্বর কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার মাঠে সাদপন্থিদের প্রবেশের সুযোগ দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা অচলের হুঁশিয়ারি দেন জুবায়েরপন্থিরা।
এমন উত্তেজনার মধ্যেই দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে গত ১৫ নভেম্বর ঢাকার কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থিদের ব্যাপক জমায়েত দেখা যায়।
‘চার সপ্তাহ থাকবেন জুবায়েরপন্থিরা আর দুই সপ্তাহ থাকবেন সাদপন্থিরা’ এমন সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সেদিন কাকরাইল মসজিদে দুই সপ্তাহের অবস্থান শুরু করেন সাদপন্থিরা।
এর মধ্যে গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা পালন করেন কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের অনুসারীরা।
এরপর ইজতেমা মাঠে ২০ ডিসেম্বর থেকে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা পালনের ঘোষণা দেন দিল্লির মাওলানা সাদের অনুসারীরা।
তবে সাদের অনুসারীদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর টঙ্গী-কালীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা।