ঘটনার মাত্র শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা দলের কিছু সদস্য সম্প্রতি ইউরোপে যান। সেখানে গিয়ে ইউরোপীয় নেতৃত্বকে বেশ কঠোর বার্তাই দিয়ে আসলেন তারা। তবে বার্তা যে কঠোরই হবে, এমনটা কিন্তু অপ্রত্যাশিত ছিল না।
মিউনিখে শুক্রবার অনুষ্ঠিত বার্ষিক নিরাপত্তা সম্মেলনে পশ্চিমা জোটের নেতাদের জন্য এটি ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের বাস্তবতার বিষয়টি উপলিব্ধি করার মতো ঘটনা।
ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে এবার ট্রাম্প কূটনৈতিক আলোচনার আগেই শুল্ক আরোপ করতে শুরু করেছেন। এতে মিত্র ও প্রতিপক্ষদের ওপর প্রভাব যেমন পড়ছে, তেমনি বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা বাণিজ্য চুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ট্রাম্প যখন নির্বাহী আদেশে সই করছিলেন, তখন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স প্যারিসে পৌঁছান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সেখানে তিনি নেতাদের জানান, আমেরিকা এই শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করবে, সবচেয়ে উন্নত চিপ আমেরিকায় তৈরি হবে, সফটওয়্যারও সেখানে তৈরি হবে। একই সঙ্গে এ সংক্রান্ত নীতিমালাও তৈরি করবে। ইউরোপকে হয় এর সঙ্গে চলতে হবে বা রাস্তা ছেড়ে দিতে হবে।
এরপরই চলে আসে ইউক্রেন প্রসঙ্গ।

ট্রাম্পের নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ গত বুধবার ব্রাসেলসে মিত্রদের এক সভায় বলেন, ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে হারানো সব অঞ্চল পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য ত্যাগ করতে হবে।
এর ঠিক কিছু সময় পরেই ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে l দীর্ঘ ফোনালাপ করেন। সেখানে তাদের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ প্রসঙ্গে আলোচনা শুরুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। রাশিয়া যেসব এলাকা দখল করেছে তা মেনে নেন ট্রাম্প এবং রুশ নেতাকে আশ্বস্ত করেন যে, ইউক্রেন কখনো ন্যাটোতে যোগ দেবে না।
ট্রাম্প যখন পুতিনের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখনই আবার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে দেশটির অব্যবহৃত বিরল খনিজসম্পদ নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
একতরফা এমন ঘোষণা ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা থেকে ইউরোপীয় নেতাদের ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে কার্যত দূরে ঠেলে দিয়েছে। এই পক্ষগুলো এতদিন ইউক্রেনের সীমান্ত এবং কিছুটা হলেও ইউরোপের ভবিষ্যতের বিষয়ে আলোচনায় ছিল। বৃহস্পতিবার তারা ট্রাম্প প্রশাসনের বার্তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন সাবধানতার সঙ্গে। কারণ ট্রাম্পের রাগের প্রভাব তাদের আরও গভীর সমস্যায় ফেলে দিতে পারে।
ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে ব্রাসেলসে ন্যাটো প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের সভার আগে বলেন, “ইউক্রেনকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সব আলোচনাতে ঘনিষ্ঠভাবে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলি বলেন, “ইউক্রেন ছাড়া ইউক্রেন নিয়ে কোনও আলোচনা হতে পারে না। ইউক্রেনের কণ্ঠ যেকোনও আলোচনায় মূল কেন্দ্রস্থলে থাকতে হবে।”
প্রথমে ট্রাম্পকে শান্তি চুক্তি করার জন্য সোশাল মিডিয়ায় ধন্যবাদ জানানোর পর গত বৃহস্পতিবার জেলেনস্কি জানান, তিনি এমন কোনও চুক্তি মেনে নেবেন না, যেখানে তিনি অংশগ্রহণ করবেন না।
তিনি বলেন, “এটি গুরুত্বপূর্ণ যে সব কিছু পুতিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী না চলে। ইউক্রেন ছাড়া ইউক্রেন নিয়ে কোনও আলোচনা হতে পারে না।”
এখন দেখা বাকি যে, ট্রাম্প প্রশাসন জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সতর্কীকরণ বার্তাটি উপেক্ষা করবে না কি মেনে নেবে। না কি মধ্যপন্থা গ্রহণ করবে, যেখানে ইউরোপ ও ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে রাখা হবে। তবে বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যগুলো ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে এমন এক ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
হেগসেথ বলেন, “সবকিছূ এখনও আলোচনার মধ্যে রয়েছে।” তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ট্রাম্প নিজে। এই কথার রেশ ধরেই তিনি আরও বলেন, “আমি ঘোষণা করতে পারব না যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী করবেন বা কী করবেন না, কী অন্তর্ভুক্ত হবে বা কি বাদ পড়বে, কোন ছাড় দেওয়া হবে বা না দেওয়া হবে।”
ধারণা করা হচ্ছে, শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং ট্রাম্পের নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিলাসবহুল হোটেল বৈরিশার হফে মিলিত হবে। আর সেখান থেকেই ইউক্রেন প্রশ্নে প্রশাসন কোন দিক নির্দেশে যাবে, তার প্রথম সূচনা হতে পারে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, ট্রাম্প ও তার দল এরই মধ্যে নতুন আমেরিকান এজেন্ডা এবং সামনে রাখা দাবিগুলো নির্ধারণ করেছেন। আর চাপ সৃষ্টিকারী কূটনীতির যুগে সেখানে অনেক দাবি রাখা হয়েছে।
গত কয়েকদিনের সাক্ষাৎকারে আমেরিকান কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর চাপ দেওয়া হবে যে, শান্তি চুক্তির পর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা প্রায় সম্পূর্ণভাবে ইউরোপের বাহিনীর ওপরই থাকবে। আমেরিকা শুধু গোয়েন্দা তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবে। তবে কোনও সৈন্য পাঠাবে না।
তারা ন্যাটো দেশগুলোকে তাদের সামরিক ব্যয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ করার দাবি জানাচ্ছেন। এর মানে হলো, বর্তমানে তাদের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ২ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সুর পরিবর্তন তার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে তা মিউনিখে স্পষ্ট। বৈঠকের অনেক সিদ্ধান্তই হয়ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হবে, কিন্তু আকর্ষণীয় সিদ্ধান্তগুলো কিন্তু গোপনেই হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জপূর্ণ হতে পারে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডের বৈঠক। তিনি রাশিয়ার বক্তব্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন, যা ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের চিন্তা বাড়িয়েছে। এছাড়া সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফের সঙ্গে বড় মিত্রদেশগুলোর গোয়েন্দা প্রধানদের বৈঠকও গুরুত্বপূর্ণ।
‘ফাইভ আইস’ নামে পরিচিত ব্রিটিশ, কানাডীয়, অস্ট্রেলিয়ান ও নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা প্রধানরা তক্কে তক্কে থাকবেন এমন কিছু বের করার জন্য, যা দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চাইবেন যে, ট্রাম্প রাশিয়ার উপর চাপ কমাচ্ছেন।
তিন বছর আগে মিউনিখে ইউরোপীয় নেতারা আমেরিকা ও ব্রিটেন রাশিয়ার আক্রমণ সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করছে কি না; এনিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। ২০২২ সালের সম্মেলন শেষ হওয়ার চারদিন পর পুতিন ঠিক সেটাই করেছিলেন। গত দুই বছর ধরে, মিউনিখ সম্মেলনে আলোচনা হচ্ছে যে, পুতিনের অবৈধ আক্রমণ ন্যাটোকে শক্তিশালী করেছে এবং এর সদস্য সংখ্যা বাড়িয়েছে।
গোপন বৈঠকগুলোতে এবং প্রকাশ্যে আমেরিকান কর্মকর্তারা বিশ্বকে আশ্বস্ত করবেন যে, ওয়াশিংটন ‘যতটা সময় প্রয়োজন’ ইউক্রেনের সঙ্গে থাকবে এবং ‘ইউক্রেন ছাড়া ইউক্রেন সম্পর্কে কিছু হবে না’ এমন প্রতিশ্রুতি দেবেন। সাইডলাইনের বৈঠকে তারা প্রতিশ্রুতির ভাষায় আলোচনা করবেন, যাতে একদিন ইউক্রেন একটি পূর্ণাঙ্গ ন্যাটো সদস্য হবে। যদিও এই ‘একদিন’ নিয়ে অনেক মতবিরোধ আছে।
বুধবার ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে ৯০ মিনিটের দীর্ঘ আলাপ হয়। এটি তিন বছরেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মধ্যে সরাসরি কথোপকথন ছিল। ট্রাম্প নিজেই ফোনালাপটি করেছিলেন এবং তিনি চারজন সহকারী নিয়ে একটি আলোচনাকারী দল গঠন করেছিলেন। তবে ইউরোপীয় বা ইউক্রেনীয়দের সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু বলেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথের বার্তা ছিল যে, ইউক্রেনের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করা ছিল ‘অবাস্তব লক্ষ্য’। তিনি দাবি করেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্য হওয়ার নতুন সময়সীমা এতটাই ভবিষ্যতে যে, সেটা এখনই হবে না।
ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের ক্ষুব্ধ করার আরেকটি কারণও আছে। ট্রাম্প ও হেগসেথের ব্যাপারটা এমন ছিল যে, তারা যেন পুতিনকে তার চাওয়া অনুসারে একটি চুক্তির রূপরেখা জানাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে এক সভায় জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বরিস পিসতোরিয়াস বলেন, “ট্রাম্প ইতোমধ্যে আলোচনার আগেই কিছু ছাড় দিয়েছেন। ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে সরাসরি আলোচনা হলে ভালো হতো।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “কোনো শান্তি চুক্তি মিথ্যা হতে পারে। পুতিন সব সময় পশ্চিমাদের প্ররোচিত করছে। একটি শান্তি চুক্তির পর হুমকি কমে যাবে, এমন ধারণা ভুল হবে।”
বড় প্রশ্ন হলো, নতুন সীমাগুলো কে রক্ষা করবে। এ বিষয়ে ট্রাম্পের দাবি, ইউরোপকেই তা রক্ষা করতে হবে। ইউরোপীয় সেনাদের ওপর আক্রমণ হলে সেটি ন্যাটো বাহিনীর ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হবে না।
ইউরোপের প্রয়োজনীয় শক্তি ও ইচ্ছা আছে এবং আমেরিকার সাহায্য ছাড়াই তারা পুতিনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে, এমনটা মনে করেন না জেলেনস্কি। তবে একজন জ্যেষ্ঠ ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেছেন, জেলেনস্কি এবং ইউরোপীয় নেতাদের এটা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে, রাশিয়ার অবৈধ আক্রমণের ফলে রাশিয়া যাতে কোনো লাভ না পায়, সেই মৌলিক নীতিতে আর একমত হওয়া যায়নি।
তথ্যসূত্র : ফরেন অ্যাফেয়ার্স, নিউ ইয়র্কার।