সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু ঘিরে সোশাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়েছে সাংবাদিকদের বিলাপ। কেউ কেউ যেন জানান দিতে চেয়েছেন কী দুরাবস্থার মধ্যে যাচ্ছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে টিকে থাকা হাজারো বিভুরঞ্জন।
সাংবাদিক কল্লোল কর্মকার এক লেখায় তুলে ধরেছেন বিভুরঞ্জন সরকারের মতো নিজের কষ্টকথা।
মিনার মাহমুদ ভাই মারা যান সম্ভবত ২০১২ সালে। ততদিনে দুটো হাউস পাল্টিয়ে তৃতীয় হাউসে যাবো যাবো করছি। তখন প্রেসক্লাবে চক্কর কাটতে হতো বেশি সময়। আমি যাদের দেশে বড় হয়েছি, মানে যাদের দেখে অণুপ্রাণিত হয়েছিলাম, তারা প্রত্যেকেই কষা লোক।
বড় মামা নরেশ কর্মকারের সূত্র ধরে একবার সন্তোষ গুপ্তের ডেরায় গিয়েছিলাম। ওই সময়টা এমন ছিল যে তার বাসায় ভাঙা চায়ের কাপ, ডলতে ডলতে পিজে যাওয়া বিছানার চাদর দেখে এক আত্মঘাতী নেশা চেপে বসেছিল। সত্যের মতো সুন্দর আরাধ্যকে নির্জলা সামনে আনতে তো এমনই কৃচ্ছতাসাধন, এমনই ধী, এমনই মোহময়হীনতা প্রয়োজন।
অল্প বয়স, সেই বিপ্লবের প্রেমে পড়ে গেলাম। ততদিনে পুরাণ ঢাকা লিটলম্যাগ করে জোনকী গলির আমি দিশারি গলি অবধি পৌছে যাই। কুমারটুলীর বাংলা মদের দোকানে মদের দামের হেরফের উপস্থিত খবরের কাগজে। আরও উপস্থিত ত্রিদিব দস্তিদারদের কবিতা। সঙ্গে উপস্থিত রাজনৈতিক চেতনা বামাবর্তের হয়ে।
রিপোর্টিং করার এক পর্ায়ে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগরে খেলাম তীব্র মার। সে এমনই মার যে, রিপোর্টিং করা ঘুচে গেল। ঠাই হলো ডেস্কে। রিপোর্টিং ছাড়তে চাইনি, কিন্তু ঘরের বড় ছেলে আমি, বাবা-মা নিত্য শঙ্কায় থাকতে শুরু করল। “দিন-রাত বলতো, বাবা আমাদের এসব এই দেশে মানায় না, ওরা আমাদের বিদেশি মনে করে।” দিনের পর দিন শুনতে শুনতে দুই বছরের গ্যাপে ফের মিডিয়ায় চলে আসি।
শুরু হয় ডেস্কের একঘেয়ে জীবন। এরপর বহু বছর চলে গেছে। এখন যে বেতন পাই, তার চেয়েও বেশি পায় আমার হাত ধরে সাংবাদিকতা শেখা অনেকে। যেহেতু বিভুদার মতো আজই আত্মহত্যা করছি না, ফলে ওদের ডিসকমফোর্টের জন্য নামগুলো বলছি না।
যতগুলো হাউসে কাজ করেছি, সবখানে বঞ্চিত হয়েছি। এখনও টাকা পাই। যত টাকা পাই তা একত্রে পেলে হয়তোবা সঞ্জীবদার মতো একদিন ঢাকায় আমার সব বন্ধুদের ডেকে সাকুরায় নিয়ে যেতে পারবো ভোজ দিতে। প্রত্যেকটা হাউস ছেড়েছি আর মনে মনে বলেছি, জীবন সায়াহ্নে একটা বই লিখবো, আর সেখানে সবগুলো খাটাশের কথা লিখে যাবো। হয়তো এও আমার একপ্রকার আত্মহত্যা।
একবার এক অনলাইনে কাজ করার সময় হলো বীভৎস এক অভিজ্ঞতা। ‘দাঙ্গা’ শব্দের জন্য মাঝরাতে গেল চাকরি, এরপর গোয়েন্দা বাহিনীর অত্যাচার। অথচ সেই শব্দটি আমি লিখিইনি। পরে আবিষ্কার হলো সত্য। শব্দটি লিখেছিলেন আমার এক সিনিয়র। তার চাকরি গেল না সম্পাদককে চামড়া উপঢৌকন দেওয়া বিনিময়ে।
এরকম বহু বহু ঘটনা…মাসের পর মাস বেতন না পাওয়া…নিউজ ডাম্পিংয়ের শিকার হওয়া… আরও কত কি!!! মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে চেয়েচিন্তে চলা, জমানো টাকা ক্ষয় করে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
এই যে এত এত চাপা কথা, ব্যথা….সেগুলোতো আউটবার্স্ট হতে হবে। হয়নি বা হয় না যে তা নয়। হয়… খুউব হয়। সূত্রাপূরে কিংবা কুমারটুলীর ঘুনসি ধরা গলির স্যাতস্যাতে দেয়ালে ঘামে স্যাতস্যাতে মানুষগুলোর সঙ্গে তাগুদের পাল্লা দিতে দিতে।
শুধুমাত্র নামের শেষে একটা সিনিয়র শব্দ যুক্ত হওয়ার বিষয়টা এই মিডিয়ায় যোগ্যতার সঙ্গে যুক্ত না। যুক্ত বেতনের সঙ্গে। ফলে নিরিবিলি কাজ করে যাওয়া আমির কপালে এই শব্দটা যুক্ত করতে যে সময় দিতে হয়েছে তা ভাবলে আমার এখন ধ্রুবর দিকে তাকাতে হয়।
মিনার ভাই, বিভুদা….নাম না জানা আরও অনেকের গল্পগুলো আসলে এক। আমাদের প্যাশনের এই ইজমের ব্যাকবোন হলো তারা। ব্যাকবোনের লিম্বার একটা একটা করে আত্মহত্যা করছে। কেউ কেউ স্বশব্দে ফেটে পড়ছে, কেউ কেউ নিভৃতে কার্নিশের শরতের শিশিরের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে।
বিভুদার ঘটনাটা পড়ার পর অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কি লিখব! কেন লিখব আসলে!! সব যেহেতু নষ্টদেরই দখলে।