প্রায় এক বছর আগে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। তা ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের কারণে। ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশছাড়া হওয়ার পাশাপাশি নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার খবরও ফলাও করে হয়েছে প্রচার।
১০ মাস পর এখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এখন শিরোনাম করছে ইউনূস সরকারের চাপে পড়ার খবর। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, ইউনূস সরকারের ওপর চাপ বেড়েই চলছে। একই রকম খবর আসছে ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
কাতারভিত্তিক আল জাজিরা ইউনূস সরকারের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখার কথা জানিয়েছে। বিবিসি বাংলা লিখেছে ইউনূস সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে।
নির্বাচনে অনিশ্চয়তা, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি অবস্থান, সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বন্দ্ব, প্রশাসনে অস্থিরতা এসবই সামনে আনছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা, অর্থনীতির দুরবস্থা এসব এসেছে খবরের উপাদান হয়ে।
একদিন আগে প্রকাশিত রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশকে একটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে পরিচালিত করার চেষ্টারত ইউনূসের সরকার সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে পড়েছে।
গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মূল কাঠামোয় সংস্কারে হাত দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বলা হচ্ছে, এটা ‘রাষ্ট্র সংস্কার’। কিন্তু সেই কাজ করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে ইউনূস সরকারকে।
গঠিত সংস্কার কমিশনের প্রায় প্রতিটির সুপারিশ পড়েছে বিরোধিতার মুখে। দুটি সুপািরশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এখন বেকায়দায় সরকার।
রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করার পর এই সংস্থার কর্মচারীদের তুমুল আন্দোলনের মুখে অধ্যাদেশ সংশোধন করতে হচ্ছে সরকােকে, যদিও অর্থ উপদেষ্টা এতদিন পিছু না হটার কথাই বলে আসছিলেন।
এরপর আন্দোলন শুরু করে সরকারি কর্মচারীরা, সংশোধিত চাকরি আইন সংশোধনী বাতিলের দাবিতে। জনপ্রশাসন তিন দিন অচল হয়ে থাকার পর সেখানেও সরকারের পিছু হটার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। এরমধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়েরে শিক্ষকরাও নেমেছেন আন্দোলনে।
ফলে শুরুতেই দুটি সুপারিশ বাস্তবায়নে হোঁচট খাওয়ার পর বাকি বড় সংস্কার কীভাবে হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এরপর নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা দিয়ে সরকারের দোদুল্যমানতায় সরকারের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চাইছে, তার মধ্যে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইছে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস সুনির্দিষ্ট না করে বারবারই বলছেন, নির্বাচন হবে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে।
অভ্যুত্থানকারী তরুণরা রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনের আগে সংস্কারের দাবি তুলছে। তাদের চাপেই সরকার নির্বাচন পেছাতে চাইছে বলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ। বিএনপি সেজন্য হুমকি দিয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে সরকারকে সহযোগিতা তারা আর করবে না।
রয়টার্স লিখেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সংস্কার শেষ করা- দুই পক্ষের এই দুই দাবির মধ্যে পড়েছে।
এর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য সরকারকে আরো চাপে ফেলে দিয়েছে। তিনি গত সপ্তাহে এক সভায় বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া উচিৎ। বাংলাদেশে এখন চাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আর অনির্বাচিত এই সরকারের চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়ার কিংবা মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা পৌঁছতে করিডোর প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই।
গত ২৪ প্রকাশিত প্রতিবেদনে আল জাজিরা লিখেছে, অন্তর্বর্তী সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের ‘স্নায়ু যুদ্ধ’ দেখা য়াচ্ছে। এই টানাপোড়েন এখন ইউনূসের ভূমিকার ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনী মাঠে থাকলেও সরকারের ওপর তাদের কর্তৃত্ব যে বেড়েছে, তা ষ্পষ্ট। একদিন আগেই সেনা সদরে সংবাদ সম্মেলন করে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি বলে দেন, এখন থেকে সব বিষয়ে তারা নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে পরিস্থিতি তুলে ধরবেন।
এরপর দেখা যায় প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করার পর জামায়াতে ইসলামীর মতো দলের শীর্ষনেতারা ছুটে যান সেনাপ্রধান ওয়াকারের সঙ্গে আলোচনা করতে।
তার আগে একটি গুঞ্জন চলছিল যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারকে পদচ্যুত করতে চেয়েছিল ইউনূস সরকার। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এরপর ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনার কথা জানাজানি হয়।
তবে পরবর্তীকালে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ খবরটি নাকচ করে দেন। তবে এর মধ্যেই একটি পক্ষ মনে করছে, ইউনূস পদত্যাগের নাটক সাজিয়ে তার হারানোর কর্তৃত্ব ফেরত পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি অস্বস্তিকর অবস্থা তো চলছেই, তার মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন সরকারের জন্য চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে বলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের বরাতে মঙ্গলবার বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তারা বলছেন, এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
রাজনীতি ও প্রশাসনের পাশাপাশি এখন অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নেই। এই অর্থনীতিই অনেকটা ডুবিয়েছিল আওয়ামী লীগকে। সেথেকে উত্তরণের আশা দিয়ে দায়িত্ব নিলেও তা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছেন ইউনূস।
গত রোববার এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ীদের অনেকগুলো সংগঠন একত্রে সংবাদ সম্মেলন ডেকে শিল্প খাতে জ্বালানি-সঙ্কট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই কারণে শিল্প কারখানার উৎপাদনে ধস নেমেছে। তাদের পক্ষে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “উট পাখি বিপদ আসলে বালুর মধ্যে মাথায় লুকায়। আমাদের উপদেষ্টারা অস্ট্রিচ পাখির মতো হয়ে গেছে। মনে হয় তারা কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। প্রতিনিয়ত কারখানা বন্ধ হচ্ছে। কিছুদিন পর মানুষ রাস্তায় নামবে। আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে।”
সরকার যে আশার বাণী শোনাচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “বড় বড় গল্প শুনি, বিডা নাকি বিদেশি বিনিয়োগকারী নিয়ে আসবে। একজন শিল্পপতিকে নিয়ে আসেন না, আমাদের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করুক। গত আট মাসে আটটা কেন, একটাও তো আসেনি।”
সামষ্টিক অর্থনীতির অঙ্কগুলো এরই মধ্যে উদ্বেগের সূচক হয়ে উঠেছে। বিদেশি বিনিয়োগ গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। রাজস্ব আদায়েও হতাশাজনক পরিস্থিতি। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। পুঁজিবাজারের সূচক কমতে কমতে ৫ বছর আগের অবস্থানে গিয়ে ঠেকেছে।
অর্থ পাচার কমেছে, এমনটাও বলা যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরে বিএফআইইউতে মোট ১৭ হাজার ৩৪৫টি সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম–সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। যদিও এই সংখ্যা আর্থিক গোয়েন্দাদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রকাশ বলে দেখানো হচ্ছে, তবে এটা এও ইঙ্গিত করে যে পাচার এখনও ভালোমতোই রয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতিকে ‘যুদ্ধাবস্থা’ বলছেন ইউনূস, এরজন্য তিনি দায়ী করছেন ক্ষমতাচ্যুত এবং নিষিদ্ধ হয়ে রাজনীতির মাঠে অদৃশ্য আওয়ামী লীগকে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
এমনকি সরকারের পাশে থাকা ব্যক্তিরাও এখন সমালোচনা না করে পারছেন না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, “সরকার বদল হলেও বাজেটের কাজের প্রক্রিয়া বদল হয়নি। বৈষম্য কমাতে, কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের মতোই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।”