১৭ বছর বয়সীদের ভোটার করার পক্ষে ইউনূস, তবে বাধা আছে আইনে

মুহাম্মদ ইউনূস
মুহাম্মদ ইউনূস

তরুণদের অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুহাম্মদ ইউনূস ভোটার হওয়ার বয়স এক বছর কমিয়ে ১৭ করার পক্ষে মত জানিয়েছেন।

শুক্রবার ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত দুই দিনব্যাপী জাতীয় সংলাপের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি তরুণদের তাড়াতাড়ি ভোটার বানানোর পক্ষে অবস্থান জানান বলে বাসস জানিয়েছে।

তবে দেশের সংবিধান ও আইনে তার এই মত বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। সেজন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে, বদলাতে হবে শিশু আইনও।

কী যুক্তি ইউনূসের?

অনুষ্ঠানে পাঠানো ভিডিও ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, “তরুণরা সংখ্যায় বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেওয়ার জন্য আমি মনে করি ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিৎ।”

তিনি যুক্তি দেখান, “যে যত তরুণ, পরিবর্তনের প্রতি তার আগ্রহ তত বেশি- এই হলো আমার যুক্তি। তরুণরা শক্তি জোগায়। তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তার গভীর সখ্য। তরুণরা সংখ্যায়ও বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী।”

নিজে তরুণদের তাড়াতাড়ি ভোটার করতে চাইলেও এবিষয়ে জাতীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন ইউনূস।

তিনি বলেন, “সংস্কারের বিষয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন। এজন্য সর্বশেষ পর্যায়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন গঠন করা হয়েছে। যেমন ধরুন-কোন বয়সে একজন নাগরিক ভোটার হতে পারবে, তার জন্য নানা দেশে নানা বয়স নির্ধারণ করা আছে। নির্বাচন সংস্কার কমিশন নিশ্চয়ই এরকম একটা বয়স সুপারিশ করবে।

“নির্বাচন সংস্কার কমিশন কী ধরনের সুপারিশ করবেন, তা আমার জানা নেই। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষ যদি কমিশনের সুপারিশ করা বয়স পছন্দ করে, ঐক্যমতে পৌঁছার জন্য আমি তা মেনে নেব।”

যে আন্দোলনে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, তার নেতৃত্বে ছিল শিক্ষার্থীরা, তাতে অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশ ছিল শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও ছিল, যাদের এখনও ভোটার হওয়ার বয়স হয়নি।

সেই আন্দোলনে সরকারের পতনের পর শিক্ষার্থীদের পছন্দে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন ইউনূস। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ এখন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। দল গঠন হলে আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে। দেড় বছরের মধ্যে সেই নির্বাচন হবে বলে এরই মধ্যে ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।

বাধা কোথায়?

বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে ১৮ বছর বয়সী ও তার ঊর্ধ্ব বয়সী নাগরিকরা ভোট দিতে পারবেন।

সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার-ভিত্তিতে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সেখানেই ভোটার হওয়ার যোগ্যতার অংশে লেখা আছে- বয়স ১৮ বছরের কম হওয়া যাবে না।

বাংলাদেশের শিশু আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত নাগরিকদের শিশু ধরা হয়। ফলে শৈশব না পেরুলে প্রাপ্তবয়স্ক বা ভোট দানের যোগ্য ধরা হওয়ার সুযোগ নেই।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার শিশু আইনের সংজ্ঞায় বয়স কমিয়ে আনার একটি উদ্যোগ একবার নিয়েছিল। সেটা নেওয়া হয়েছিল ‘কিশোর গ্যাং’র দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় তাদেরও প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো বিচারের আওতায় আনতে।

সরকারের আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি তেমন সুপারিশ করলেও শিশু অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন মহলের বিরোধিতায় সেই উদ্যোগ হালে পানি পায়নি।

তখন আওয়ামী লীগ সরকারের সেই উদ্যোগের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, শিশুর বয়স কমানোর সিদ্ধান্ত হবে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু বিবেচনা করা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

শিশু অধিকার রক্ষাবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু সেই উদ্যোগের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, শিশু সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সব সনদে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর বিষয়টিতে বাংলাদেশ সরকার সমর্থন দিয়ে স্বাক্ষর করেছে। ফলে বয়স কমানো হবে ওই সব নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কেন ১৮ বছর বয়সের আগে প্রাপ্ত বয়স্ক ধরা হয় না, তার ব্যাখ্যায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বিজ্ঞানের ভাষায়, একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের গঠন সম্পন্ন হয় ১৮ বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে। এই কারণেই আন্তর্জাতিক শিশু সনদে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮ বছরের আগে যেহেতু একজন মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ হয় না, ফলে নিজের বিবেচনায় ভোট দেওয়ার সক্ষমতাও তার গড়ে ওঠার কথা নয়।

সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ভোটার এখন ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। যা প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার ৭১.৭৪ শতাংশ। সর্বশেষ হালনাগাদে ২১ লাখ ৬০ হাজার নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছিল তালিকায়।

আগামী নির্বাচনের আগেও ভোটার তালিকা হালনাগাদ হবে।

আরও পড়ুন