বঙ্গবন্ধু ভবন ধ্বংস : দায় ঘাড়ে আসছে দেখে নড়ল ইউনূসের টনক

বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে তছনছ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে তছনছ করা হয়।

শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের সরকার প্রধান হয়ে দুই দিন ধরে দেখলেন অশান্তির আগুন। সেই আগুনে ধ্বংস হল দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচিহ্ন।

বুধবার বুলডোজার মিছিলের ঘোষণা দিয়ে যখন ঢাকার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি ধ্বংস করা শুরু হলো, তখন দেশে সরকার থাকলেও সরকারি বাহিনীর কোনো তৎপরতাই ছিল না।

রাত গড়িয়ে দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর ইউনূস সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম প্রতিক্রিয়া এল। তাতে এই ঘটনাটিকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত বলা হলেও এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হলো ভারতে থেকে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দেওয়াকে।

বৃহস্পতিবারের সেই বিবৃতির মধ্য দিয়ে দৃশ্যত বোঝা গেল, ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবন ও সুধা সদনসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ধরে ধরে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগে সরকারের সায় রয়েছে। এই হামলা ঠেকাতে পুলিশের কিংবা আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের না যাওয়া সেই ধারণা আরো জোরাল করে।

শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জনরোষে পড়েছিল বঙ্গবন্ধু ভবনসহ আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট স্খাপনাগুলো। তখন দেশে সরকার ছিল না বলে দায় চাপানোর কাউকে পায়নি কেউই। তার তিন দিন পর ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

ছয় মাস পর সেই সরকারের বৃহস্পতিবারের বিবৃতির পর ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ চলতেই থাকে বিভিন্ন সময়। তবে এবার যেহেতু সরকার রয়েছে, তাই নৈরাজ্য ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য সরকারের দিকে উঠছে অভিযোগের আঙুল। বিশিষ্ট নাগরিকরা বিবৃতি দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ শাখা টিআইবি প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মুখ খুলছেন।

এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস নতুন বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে শেখ হাসিনার কিংবা আওয়ামী লীগের কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হামলা না চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

৭০ ঘণ্টা ধরে হামলা চলার পর তা থামানোর আহ্বান জানান তিনি; অথচ তা ঠেকানোর উদ্যোগ না নেওয়ার পাশাপাশি থামানোর আহ্বান আগে জানান তিনি।

এখন কেন জানালেন? সেই প্রশ্নের একটা উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় তার বিবৃতিতে। যেখানে তিনি বলেছেন, এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেকোনো অবনতি বিশ্বকে ভুল বার্তা দেবে। কারণ আওয়ামী লীগ তাদের ওপর আক্রমণ নিয়ে বহির্বিশ্বের কাছে প্রচার চালাবে।

যে সমালোচনা হচ্ছে

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, গত কিছুদিন ধরেই একথাটি বলে আসছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। কিন্তু গত কয়েকদিনের নৈরাজ্য ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা মাঠে থাকা সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা দৃশ্যমাণ না হওয়ায় সেই দাবি পড়েছে প্রশ্নের মুখে।

তার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে সরকারের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি আসে, তাকে দায় এড়ানোর চেষ্টা হিসাবে দেখেন নাগরিকরা। সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাংচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার। পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

শুক্রবার এক বিবৃতিতে দেশের বিশিষ্ট ২৬ নাগরিক বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে নির্মমতার সঙ্গে বাড়িটি ধ্বংস করা হয়েছে।

“তা দেখে একটি সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত, স্তম্ভিত ও লজ্জিত। এমন লজ্জাজনক ঘটনার নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর উপযুক্ত ভাষা আমাদের জানা নেই। ঘটনাটির আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

বিবৃতিতে বলা হয়, ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনার দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ওপরেই অনেকাংশে বর্তায়। সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা–পরবর্তী একটি বিবৃতি দিয়ে এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

বিবৃতিতে এটাও বলা হয়, “কোনো ধরনের গণ–উত্তেজক সহিংসতা বা মব ভায়োলেন্স কেবল ফ্যাসিবাদের কর্মী-সমর্থক এবং তাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকদের নাশকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকেই উৎসাহিত করবে।

“বিগত পতিত সরকার ও তার সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে নানা নাশকতার পরিকল্পনা যেমন করেছে, তেমনি দেশে এখন আইনের শাসন নেই বলেও দেশ-বিদেশে যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, তার হাতও এতে শক্তিশালী হবে।”

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী, আনু মুহাম্মদ, খুশি কবির, পারভীন হাসান, ইফতেখারুজ্জামান, শামসুল হুদা, সারা হোসেন, সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সুব্রত চৌধুরী, নুর খান, শাহনাজ হুদা, নোভা আহমেদ, জোবাইদা নাসরীন, মোহম্মদ সেলিম হোসেন, শাহ-ই-মবিন জিন্নাহ, জাকির হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, মনীন্দ্র কুমার নাথ, সাঈদ আহমেদ, মিনহাজুল হক চৌধুরী, আশরাফ আলী, শাহাদত আলম, রেজাউল হক, হানা শামস আহমেদ ও মুক্তাশ্রী চাকমা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদশ-টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়, “আগে থেকে সহিংস কর্মসূচির ঘোষণা থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা সংস্থা ও তার সঙ্গে সহায়ক হিসেবে দায়িত্বপালনরত সেনাবাহিনী, তথা সরকার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আশঙ্কাজনকভাবে নির্লিপ্ততার পরিচয় দিয়েছে।

“পরবর্তিতে ঘটনাটি ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত’ এমন বিবৃতি দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টাও লক্ষণীয়। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে শুধু বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সম্পন্ন করা নয়, সরকারের কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য।”

বিএনপিও সরকারের ব্যর্থতার দিকটি দেখিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, একটি সরকার বহাল থাকা অবস্থায় জনগণ এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিলে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু ভবন যেটিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। শুধু ভবন নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্মৃতি স্মারক নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি-ঘর ভাংচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। জাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবিসহ আরও রাজনৈতিক দলও একই রকম বক্তব্য তুলে ধরে বিবৃতি দেয়।

তবে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে এক সমাবেশে সরকারের বিবৃতির সুরেই বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “হাজার হাজার মানুষ যারা গুম-খুন হলো, তারা যখন হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে; সেইসময় আবার আপনারা উসকানি দেন। এটা কি বাংলার মুক্তিপাগল মানুষ সহ্য করবে? সুতরাং, উসকানির কারণে যে পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তার সমুদয় দায় উসকানিদাতাদেরকেই নিতে হবে।”

সমালোচনার পর কঠোর হওয়ার বার্তা ইউনূসের

নৈরাজ্য ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য যখন সরকারের সমালোচনা হচ্ছে, তখন শুক্রবারের বিবৃতিতে কঠোর হওয়ার বার্তা দেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস, যা সরকারের আগের দিনের বিবৃতিতে ছিল না।

দেড় দশকের অপশাসনের জন্য আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের ক্ষোভের কথা দিয়ে বিবৃতি শুরুর পর ইউনূস বলেন, “তা সত্ত্বেও সরকার দেশের সব নাগরিককে আইন মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে পুরোনো বাংলাদেশ থেকে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে একসঙ্গে কাজ করছি, আইন মেনে চলার মধ্য দিয়েই সেটি আলাদা হবে।”

এই পর্যায়ে সবাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের বিজয়ীদের নিশ্চয়ই এমন কিছু করা উচিৎ হবে না, যা দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং স্বৈরাচারী হাসিনার আমলের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

“তাদের সম্পত্তিতে যেকোনো আক্রমণকে তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করার এবং তাদের বানোয়াট গল্প প্রচার করার সুযোগ হিসেবে নেবে। এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলার যেকোনো অবনতি বিশ্বকে ভুল বার্তা দেবে।”

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি কঠোর হওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং সব বাংলাদেশির জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য সরকার দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে।

“সম্পত্তি ধ্বংস, ব্যক্তির ওপর আক্রমণ কিংবা কোনো ধরনের উসকানিমূলক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অবিলম্বে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী যে কারও বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সরকার বিচারের আওতায় আনবে।”

নৈরাজ্য সৃষ্টির নেপথ্যে কী

গত ৫ আগস্ট থেকে ভারতের থাকা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এর আগেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রেখেছেন।

ইউনূস সরকারের পক্ষ থেকে তার মুখ বন্ধ রাখতে এর আগেও নয়া দিল্লিকে আহ্বান জানানো হয়েছিল। বুধবার রাতে শেখ হাসিনা পুনরায় বক্তব্য দেওয়ার পরও ফের ঢাকায় ভারতের উপ রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে ফের আহ্বান জানানো হয়।

তার পাল্টায় ভারত সরকারও শুক্রবার দিল্লিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এরপর সাংবাদিকদের বলেন, “দুঃখজনকভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ের জন্য আমাদের দায়ী করে প্রতিনিয়ত বক্তব্য দিয়ে আসছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ, যাতে ভারতকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের এসব বক্তব্যই পরিস্থিতি ক্রমশ নেতিবাচক হওয়ার জন্য দায়ী।”

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে জয়সওয়াল বলেন, “শেখ হাসিনা নিজ দায়িত্বে বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই।”

বাংলাদেশ সরকার বলছে, ভারত শেখ হাসিনাকে উসকানি দেওয়ার পথ করে দিচ্ছে; অন্যদিকে নয়া দিল্লি দায়ী করছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উপাদানকে।

আবার মুহাম্মদ ইউনূস এখন বলছেন, তারা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চান না, কারণ তা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকেই সুবিধা করে দেবে।

তার মধ্যে এই প্রশ্নও আসছে, তাহলে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে আসলে কারা কী হাসিল করতে চাইছে?

দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনার তৎপরতা নিয়ে এর আগে সমালোচনা করেছিল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কিন্তু বুধবার তারা আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি দেয়নি।

শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহকেই বুধবারের কর্মসূচি নিয়ে তৎপর দেখা গেছে। তবে তিনি ফেইসবুকে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।”

এরপর একে ‘বুলডোজার মিছিলে’ রূপ দেন ফ্রান্স প্রবাসী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “যে মুহূর্তে সে (শেখ হাসিনা) বক্তব্য দেওয়া শুরু করবে, সেই মুহূর্তে আপনার দলে দলে আসবেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে, বুলডোজার নিয়ে আসবেন।”

পিনাকীর সঙ্গে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ইউটিউবার ইলিয়াস হোসেন। তারপর সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ‘বুলডোজার মিছিল’র ফটোকার্ড। তাতে সবাইকে ধানমণ্ডিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা চালাতে বলা হয়।

বুধবার রাত থেকে পরবর্তী দুই দিন বঙ্গবন্ধু ভবন ধ্বংসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষনেতাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। তবে এই প্ল্যাটফর্মের ধানমণ্ডি থানা শাখা ব্যানার নিয়ে ছিল সেখানে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা থেকে উপদেষ্টা হওয়া নাহিদ ইসলাম কিংবা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়ার কোনো তৎপরতাও ছিল না। এই আন্দোলন থেকে উপদেষ্টা হওয়া মাহফুজ আলম শুধু একটি ফেইসবুক পোস্টে বলেন, “ভাঙার পরে গড়ার সুযোগ এসেছে, কিন্তু অনন্ত ভাঙা প্রকল্প আমাদের জন্য ভালো ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবহ না। গড়ার প্রকল্পগুলো খুব দ্রুতই শুরু ও বাস্তবায়ন হবে। আপনারা গড়ার কাজে সক্রিয় হন।”

কিন্তু ততক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন ছাপিয়ে ভাঙা-ভাড়ি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাহলে ভাঙার কাজটি কাদের উদ্যোগে হচ্ছে?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপদেষ্টা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমি তো ঘটনা দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ি।”

জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকে এই ভাঙাভাঙির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন। তারা বলতে চাইছেন, এর মধ্য দিয়ে ‍সুকৌশলে আওয়ামী লীগের লাভের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।

শেখ হাসিনার আগের ভার্চুয়াল ভাষণ সেভাবে কারও নজরে আসেনি। কিন্তু বুধবারের কর্মসূচির পর অনেকে প্রথম জানতে পারে যে শেখ হাসিনা ভাষণ দিচ্ছেন। তাতে সেই ভাষণ শোনার আগ্রহও মানুষের বেড়ে যায়।

আবার যে শঙ্কার কথা ইউনূসের বিবৃতিতে বলা হয়, তা সামনে এনে কেউ কেউ বলছেন, এই পরিস্থিতি দেখে বলে মানুষের মনে ধারণা হবে যে আওয়ামী লীগ আমলই ভালো ছিল। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে আওয়ামী লীগ নিজেদের নির্যাতিত হিসাবে তুলে ধরে তাদের সব অপকর্ম ঢাকার সুযোগ পাবে।

সব মিলিয়ে একটি বড় ফাঁকির মধ্যে দেশবাসী রয়েছে বলে মনে করেন লেখক-রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিদ্দিন আহমদ। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেভাবে ভাংচুর হচ্ছে, এটা যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে কিন্তু যে কাউকে বলতে পারে অমুকে স্বৈরাচারের দোসর বা অমুকে আওয়ামী লীগ করতো বলে বাড়িঘর ভাঙ, দোকানপাট লুট করো। এটা হতে থাকবে।”

গত ৫ আগস্টের ঘটনার যতটুকু দেখা গেছে, তার পেছনে আরো কিছু আছে দাবি করে এই বিশ্লেষক বলেন, “আমরা চোখের সামনে যে ঘটনাটা দেখছি, তার আড়ালে কিন্তু অনেক কিছু আছে।

“শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়নি, বরং তাকে দিল্লিতে রেখে আসা হয়েছে। তাকে ফিরিয়ে এনে বিচার করার আলাপে বিশাল ফাঁকি আছে। আর এই ফাঁকিটা মানুষকে দেওয়া হচ্ছে।”

দিল্লিতে থেকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চাইছেন দাবি করে সমাজ বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “খুনিদের আশ্রয় দেওয়া এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে আসলে কোনো সরকার নাই এটা প্রমাণ করা দিল্লির নীতি। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে দিল্লির তরফ থেকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা আরও তীব্র হয়েছে এবং হবে।”

লেখক ফাহাম আবদুস সালামও একই মত প্রকাশ করে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সে ইন্ডিয়াকে বোঝাতে চায়, বাংলাদেশের অবস্থা খুব খারাপ এবং এটা দিয়ে যদি ট্রাম্প প্রশাসনের থেকে কোনো ফায়দা নেয়া যায়।”

তাদের দুজনের কথা অনুযায়ী শেখ হাসিনাই যদি এটা চান, তাহলে তার আশা পূরণ কেন করে দেওয়া হচ্ছে, আর সরকার সেটা বুঝেও কেন ঠেকাল না, সেই প্রশ্নও চলে আসে।

তবে ফাহাম আব্দুস সালাম বলছেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওইদিন হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যাবেলায় হুট করে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না।”

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামাতা ফাহাম একথা বললেও বিএনপির বক্তব্য, সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে মুন্সিয়ানা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। দলটি বেশ উদ্বিগ্ন চলমান ঘটনাপ্রবাহে। শুক্রবার দলের স্থায়ী কমিটি বৈঠকে বসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফরহাদ মজহার আবার এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে জনগণের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে করছেন।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এই ঘটনার মধ্যে ষড়যন্ত্রের আঁচ পাচ্ছেন। তিনি শুক্রবার ঢাকার পল্টনে এক সমাবেশে বলেন, “বিপ্লবের নামে জনগণকে উসকানি দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে যেন থার্ড পার্টি ক্ষমতা টেকওভার করতে পারে।”

পরিস্থিতি সুতার ওপর ঝুলছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, “এখন যা চলছে, এটাকে আমরা এক শব্দে বলতে পারি মবতন্ত্র। এই মবতন্ত্রকে একবার আশকারা দিলে, সেখান থেকে ঘুরে গণতন্ত্রে আসাটা খুবই কঠিন হবে, অসম্ভবও হয়ে উঠতে পারে।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

কোথায় কী ভাঙচুর, লুটপাট? মাঝরাতে ইউনূসের বিবৃতি

শেখ হাসিনাকে কি ফেরত পাঠাবেন? রাজ্যসভায় প্রশ্ন

বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার খবর যেভাবে ছেপেছে দেশের গণমাধ্যম

৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দেওয়ার খবর যেভাবে এসেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়

বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ায় ভারতের নিন্দা, পাকিস্তানির উল্লাস

কান্নাভেজা কণ্ঠে বিচার চাইলেন শেখ হাসিনা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads