ওয়ান-ইলেভেনের পরের কথা যাদের স্মরণে আছে, মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের কথা তার মনে থাকার কথা। নাগরিক শক্তি নামে একটি দল নিয়ে মাঠে নামতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনীতির বিশাল সাগরে থই না পেয়ে হাল ছেড়ে দেন।
নোবেল জয়ের রেশ থাকতে থাকতে ওই অভিজ্ঞতা নিতে হয়েছিল তাকে। তারপর আর দল গঠনের চেষ্টায় নামেননি। এক সাক্ষাৎকারে এমনও বলেছিলেন, ন্যাড়া বেলতলায় কয়বার যায়।
জরুরি অবস্থার সেই সময়ে শুধু ইউনূসই নন, আরও অনেকে দল গঠনের চেষ্টায় মাঠে নেমেছিলেন। ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী গঠন করেছিলেন পিডিপি; নাজমুল হুদা গড়েছিলেন বিএনএফ। বলা হয়, এসব দল গঠনের নেপথ্যের কারিগর ছিল সেনাবাহিনী। এই কিংস পার্টিগুলো রাজনীতিতে কোনো ছাপই রাখতে পারেনি।
সময়ের পরিক্রমায় আরেকটি অস্বাভাবিক সময়ে ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান, তখন আবার নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের হিড়িক দেখা যাচ্ছে।
তরুণদের চাকরি না খুঁজে চাকরিদাতা হয়ে উঠতে আহ্বান জানিয়ে আসছেন ইউনূস। ফলে সেই প্রেরণা থেকেই ভোট দিতে দল না খুঁজে অনেকে নিজেরাই দল গড়ে তুলছে, এমনটা ভাবাও অস্বাভাবিক হবে না।
আওয়ামী লীগ সরকার হঠানোর অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাশাপাশি নিউক্লিয়াস পার্টি, জনপ্রিয় পার্টি, জাগ্রত পার্টি, আমজনতার দল, আ-আম জনতা পার্টি এমন হরেক নামের দল এরই মধ্যে গঠিত হয়েছে।
শুক্রবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি দল- ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’। এই দলের নেতৃত্বে দিচ্ছেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন তিনি। মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি, বিএনপি তেকে বহিষ্কৃত শওকত মাহমুদকে।
নতুন দল গঠনের কারণ জানিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমি অনেক দিন ধরেই জনসেবা করছি। এবার সেটা একটা সংগঠিত কাঠামোর মধ্যে আনছি।”
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি; যদিও নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি।
বিবিসি বাংলা হিসাব কষে দেখিয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের অগাস্ট থেকে গত আট মাসে অন্তত ২২টি রাজনৈতিক দল ও ও চারটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে তিনটি করে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হয়েছে।
এত অল্প সময়ে এতগুলো নতুন দল কেন? সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই ওঠার কথা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আগেও নানা সময়ে এমন নতুন নতুন দল গঠনের প্রবণতা দেখা গেছে। নির্বাচনের সময় এলেই ব্যাঙের ছাতার মতো অনেক দল গজিয়ে ওঠে।
নির্বাচন কমিশনে এখন নিবন্ধিত দলের সংখ্যা অর্ধশতের মতো। তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী না থাকলেও জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মাঠে তারা বেশ সক্রিয়।
নতুন দল গঠন করলেই অবশ্য নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নিশ্চয়তা মেলে না। নিজেদের প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিতে হলে প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন।
সেই নিবন্ধন পেতে নানা শর্ত পূরণ করতে হলেও না ফাঁক গলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলই নিবন্ধন বাগিয়ে নিয়েছে। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচনের আগেও এমন কিছু দল নিবন্ধন পেয়েছিল, যাদের কোনো কার্যক্রম আগে-পরে আর দেখা যায়নি।
কারা আনছে?
গত ১৭ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি। এর নেতৃত্বে রয়েছেন বিতর্কিত এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রফিকুল আমীন।
দুর্নীতির মামলায় ১২ বছর কারাভোগের পর গত ১৫ জানুয়ারি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার তিন মাসের মাথায় রাজনীতিতে নাম লেখান তিনি।
মূলত রাজনীতি করলে সুবিধা পাওয়া যায়, তা বোঝার পরই তিনি নতুন দল গঠনে নামেন বলে বিবিসি বাংলার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন রফিকুল আমীন।
নতুন দলগুলোর মধ্যে আছে, নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, দেশ জনতা পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, জনতার বাংলাদেশ পার্টি, জনতার দল, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি)।

এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলো ইলিয়াস কাঞ্চনের জনতা পার্টি বাংলাদেশ। ঢাকার একটি পাঁচতারা হোটেলে দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান হয় ‘গড়বো মোরা ইনসাফের দেশ’ স্লোগানে।
দলটিরঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪-এর চেতনায় বিশ্বাসী এবং গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বিদ্যমান দলগুলোর প্রতি জনআস্থা কমে যাওয়ায় দেশের মানুষ বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছে, আর জনতা পার্টি সেই চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখবে।
কেন আনছে?
নতুন দল গঠনের পর এগুলোর উদ্যোক্তারা যখন ইসির নিবন্ধনের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন, তখন সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, কেন এসব নতুন দল হচ্ছে?
মো. হারুন নামে ঢাকার এক ভ্যানচালক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশে মনে করেন ১০ জনেও দল করন যায়। যার যার মতো খালি দল বানাইতাছে আর করতাছে। এগিলির কোনো ইস্টিমেট আছে? এগিলা দল আমরা ভ্যান গাড়িয়ালারাও বানাইতে পারি।”
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থাকলেও এগুলোর বেশিরভাগের নামই কেউ জানে না। তার সঙ্গে আরও দল গঠনের বিষয়টি মাথায় নিতে চান না কেউ।
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, উন্নয়নকর্মী ও রাজনীতি বিশ্লেষক শরিফুজ্জামান শরিফ এনিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন – “অনেকে বাসার চাপ সহ্য করতে পারছে, অনেককে না পেরে দল খুলতেই হচ্ছে! ৫ আগষ্টের পর এই পর্যন্ত ২৩টা দল খোলা হয়েছে।
“কদিন আগে ডেসটিনি গ্রুপের নতুন প্রডাক্ট বাজারে এসেছে,আ আম জনতার পাটি। আ আম কেন? অনেকে জানতে চেয়েছিলেন- বলেছিলাম এটা আ সিরিজের পার্টি। প্রাইজ বন্ড এর মতো আর কী!”
ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে বসে ‘ইনসাফ প্রতিষ্ঠার’ আওয়াজ তোলা নিয়ে শরিফ বলেন, “ইন্টার কন্টিনেন্টালে সুট পরা লোকজন গিয়ে দল গঠন করে ইনসাফ এর স্বপ্ন দেখছে- ভালো।”
নতুন দল গঠন নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এর আগেও আমরা দেখেছি, যখন নির্বাচনের গন্ধ এসে নাকে লাগে, তখন হঠাৎ করেই এমন অনেক দল গজিয়ে ওঠে ব্যাঙের ছাতার মতো।
“এরশাদের আমলে বড় দলগুলো এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনে সহযোগিতা করেনি বা করতে চায়নি, তখন এরশাদ দেখাতে চেয়েছিল যে দেশে প্রচুর রাজনৈতিক দল আছে। সুতরাং তারা নির্বাচনে এলে তো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। সেসময় ১২০টার বেশি দল গঠন হয়েছিল।”
ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেও এসব দল তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এখন একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে সবার মধ্যে যে রাজনীতি করলে খুব দ্রুত লাভবান হওয়া যায়। রাজনীতি করলে খুব দ্রুত টাকা-পয়সা কামানো যায়, আর ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানো যায়।”
তবে বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস বলছে, অনেক দল এলেও তাদের মধ্যে নগন্য সংখ্যকই শেষে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: