বাংলাদেশ ও বিশ্ব নিয়ে নিয়মিত লিখে আসছেন সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ, যিনি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন এনায়েতুল্লাহ খানের প্রখ্যাত সাপ্তাহিক হলিডে দিয়ে। এরপর সাংবাদিকতার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করে গেছেন কয়েকযুগ। সর্বশেষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ছিলেন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে। সাম্প্রতিককালে সোশাল মিডিয়ায় ‘মিডিয়া ওয়াচ’ শিরোনামে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজের মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছেন এই অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পাঠকের জন্য তার সর্বশেষ লেখাটি হুবুহু তুলে দেওয়া হলো।
একটা নতুন সরকারি আদেশ দেখলাম, আগামী পাঁচ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকার নানা আয়োজনে দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিনকে বিভিন্নভাবে আখ্যায়িত করা।
১৬ জুলাই: শহীদ আবু সাঈদ দিবস। গত বছর এই দিনে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে হাসিনাবিরোধী আন্দোলন নতুন গতি পায়। ৫ আগস্ট: জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস। গত বছর ওই দিনে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হয়। এবং ৮ আগস্ট: নতুন বাংলাদেশ দিবস।
প্রথম দুটো দিন নিয়ে কারো মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আমিও ব্যক্তিগতভাবে এগুলোর সঙ্গে একমত। কিন্তু ৮ আগস্টকে নতুন বাংলাদেশ দিবস হিসেবে উদযাপনের ঘোষণাটি আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। এর বিপক্ষে নানা আলোচনা সমালোচনা দেখতে পাচ্ছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আমার ঠিক বোধগম্য নয় কী কারণে ৮ আগস্ট কে “নতুন বাংলাদেশ” দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলো।
আমার মনে হয়েছে এটা সম্পূর্ণভাবে ইউনূস সাহেবের ব্রেন চাইল্ড। ওইদিন তার ক্ষমতা নেওয়ার দিনটিকে একটা বিরাট ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করাই হলো তার মুখ্য উদ্দেশ্য।
একটা বিশেষ দিনকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হবে এটা কোন একক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এরকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জাতীয় পর্যায়ে কেন আলোচনা করা হলো না? শুধু এই আন্দোলনের স্টেকহোল্ডাররাই না, পতিত হাসিনা লীগ ছাড়া সবাইকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কনফিডেন্সে আনা উচিত ছিল।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো এই ঘোষণাটি আসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী। অর্থাৎ অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই ইউনূস সাহেব এটা নির্বাহী আদেশে নির্ধারণ করেছেন।
এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া ছিল fast and furious। ঘোষণাটি জারি হওয়ার পরপরই দেখলাম জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের তিন অগ্রসৈনিক- হাসনাত আব্দুল্লাহ, সার্জিস আলম, আখতার হোসেন এটার তীব্র বিরোধিতা করেছে।
গতকাল ফেসবুক পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেছে, “নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ৫ আগস্ট। ৮ আগস্ট না। পাঁচ আগস্টের সাধারণ ছাত্র-জনতার এই অর্জনকে সরকারের কুক্ষিগত করার চেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না”।
আক্তার হোসেন লিখেছে, “নতুন বাংলাদেশ দিবস সেদিন হবে, যেদিন জুলাই ঘোষণা পত্র আসবে, যেদিন মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে’।
তবে আরও কঠোর ভাষায় এর সমালোচনা করেছে সার্জিস আলম। সে বলেছে, “৮ আগস্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতা শুরু হয়নি। দ্বিতীয় স্বাধীনতা নষ্টের, ছাড় দেওয়ার এবং বিপ্লব বেহাতের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ এবং ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’।”
একবার চিন্তা করে দেখেন যে এই তরুণ অগ্রসৈনিকরা ইউনূসের এই হঠকারী সিদ্ধান্তে কতখানি ক্রুদ্ধ হলে পাবলিকলি এই মন্তব্যগুলো করতে পারে।
আমি নিজেও কিছুটা বিস্মিত হয়েছি যেটা আগেই উল্লেখ করেছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে এগুলো ইউনূস সাহেব করছেন শুধুমাত্র বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য। এর উদ্দেশ্য হল তার আমলে যে ব্যাপক লুটতরাজ, বিচারহীনতা, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, সর্বোপরি যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে সেদিক থেকে সাধারণ জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো। এগুলো করা হচ্ছে একই স্টাইলে। যেমন অত্যন্ত স্পর্শকাতর জাতীয় বিষয়গুলোকে তিনি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি ম্যানেজমেন্টের কাছে দেওয়া; রাখাইনে মানবিক করিডর দেওয়া; এবং স্টারলিংক দেশে আনা। এর মধ্যে শুধুমাত্র স্টারলিংক ছাড়া অন্য গুলোর ব্যাপারে তিনি সফল হননি।
এছাড়াও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার, ৬৬৬ কোটি টাকার কর্ মওকুফ, গ্রামীণ ব্যাংক এবং অন্যান্য অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর নানান সুযোগ সুবিধা নেওয়ার কথা আপনারা সবাই জানেন। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে তার অগ্রাধিকার হলো কিভাবে দেশের টাকা খরচ করে বিদেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানো যায়। ইতিমধ্যে দশ মাসে ১১ বার বিদেশ সফর করেছেন বিশাল দলবল নিয়ে।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে এসবের মূল উদ্দেশ্য এগুলো নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করা যাতে করে নির্বাচন বিলম্ব করে দীর্ঘদিন কিভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় এবং এই গরীব রাষ্ট্রের টাকা ব্যক্তি স্বার্থে দিনের পর দিন কিভাবে খরচ করা যায়।
এ প্রসঙ্গে আবারও মনে করিয়ে দেই জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তার সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন। আজ পর্যন্ত সেটা তিনি করেননি। এটাতো জাতির সংগে এক বড় প্রতারণা।
আমি প্রায়ই ভাবি যার মধ্যে বিন্দুমাত্র দেশপ্রেম আছে সে কি এ কাজগুলো করতে পারে?
এ সংক্রান্ত আরও খবর: