রিগা’র ডায়েরি: পরতে পরতে ইতিহাসের জলছাপ

রিগার ওল্ড টাউনে ইট-পাথুরে রাস্তাগুলো যেন এক একটি ইতিহাসের স্মারক।
রিগার ওল্ড টাউনে ইট-পাথুরে রাস্তাগুলো যেন এক একটি ইতিহাসের স্মারক।

রিগার বিখ্যাত দাউগাভা নদীর পাড়ে বসে। অস্তাচলে যাওয়া সূর্যটার মতোই যেন তেজহার গোটা শহর। অথচ কয়েকঘণ্টা আগেও হাঁকডাক, কোলাহলে মুখর ছিল ভানশু সেতুর চারপাশ। শুনেছি এই দাউগাভা নদীর পাড়ে বসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিছু একটা লিখেছিলেন! ঠিক কী লিখেছিলেন সেটির খোঁজ না করে বরং কী লেখা যায় তা নিয়েই ভাবছি!

কেউ বলে লাটভিয়া, কোথাও ল্যাটভিয়া আবার লাতভিয়াও বাঙলায় লিখতে দেখেছি। রিগা তার রাজধানী। দেশটি কয়েক দশক আগেও ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। তখন আমরা ছোট। নব্বই সাল। এর পর থেকে ল্যাটভিয়া ছোট্ট জনপদের স্বাধীন দেশ। ১৮ লাখ মানুষের এই দেশটি সোভিয়েত শাসন থেকে বেরিয়ে এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত। নিয়েছে ন্যাটোর মেম্বারশিপ। বেশিরভাগ মানুষ ল্যাটভিয়ান ভাষা কথা বললেও বিভিন্ন সাইনবোর্ডের দিকে তাকালে ধরতে অসুবিধা হয় না যে এখানে এখনও রুশের আধিপত্য। যদিও স্বাধীন দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভের পর ওদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ তীব্র!

ধূর ছাই! কী লিখছি এসব। মানুষ এমনিতেই লেখা পড়ে না, তার উপর ইতিহাস টানছি; এখন তো মোটেও পড়বে না! না পড়ুক। আমি লিখতে বসে কখনও কে পড়বে আর কে পড়বে না তা ভাবিনি, আজও ভাববো না!

এই দাউগাভা নদীর কথা উঠে এসেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক ভ্রমণ কাহিনীতে।

এবারের ল্যাটভিয়া ভ্রমণ মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক। মানে রিগা। আমরা যেখানটায় উঠেছি, জানালার পর্দা গলে দাউগাভা নদী আর ভানশু ব্রিজ স্পষ্ট দেখা যায়। ভানশু সেতুর একটা বিশেষ দিক হলো প্যারাদাউগাভা আর ওল্ড টাউনকে যোগ করেছে এটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের একদশক আগে এই ক্যাবল ব্রিজটির নির্মাণ শেষ হয়েছিল। ব্রিজের নিচ থেকেই ছাড়ে শহর ঘুরিয়ে দেখানোর ছোট ছোট ইঞ্জিন নৌকা। রিগায় একদিকে প্রধান আকর্ষণ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মানচিত্র, অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আমার অবশ্য ওল্ড টাউনের চেয়ে উরমালা সৈকত খারাপ লাগেনি। কতদিন হলো সাগরের গর্জন শুনি না, এখানে এসে গর্জন না শুনলেও বিড়ালের ম্যাঁও ডাকেই তুষ্ট! গরম বালুর সৈকতের বুকে লিখে এসেছি- আমাকেও সাথে নিও! উত্তুঙ্গ বাতাসের কানে কানে বলে এসেছি- লেনিন এসেছিল; রুশ নয়, বাঙলার ছোঁয়া দিতে!

ঢেউগুলো যখন আছড়ে পড়ছিল কেন জানি মনে হচ্ছিল কোনো বন্দির আর্তনাদ, কিংবা রাশিয়ার জন্য বিলাপ। দীর্ঘ সৈকতে মানুষের পায়ের ছাপ। মোটামুটি ব্যস্ত বিচ বলা চলে! তাই বলে আমার দেশের মতো নয়। পর্যটকদের ভিড় দেখে বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। নিদারুণ অবহেলায় পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত! তবে যেটাই হোক, উরমালার মায়াবী ডাক উপেক্ষা করার উপায় নেই।

রোল্যান্ডের এই সুউচ্চ মূর্তিটির দিকে তাকালে মনে হবে যেন দাঁড়িয়ে থেকে আজও পাহারা দিচ্ছে রিগার প্রাচীন মূল্যবোধ।

শুরুতেই বলেছিলাম রিগার পরতে পরতে ইতিহাসের ছাপ। পুরনো শহরের ইট আর পাথুরে পথ ধরে হাঁটতে গিয়ে মনে আসছিল এ যেন চলন্ত জাদুঘর। ঐতিহ্যের প্রতি কী ভীষণ শ্রদ্ধা। ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে টাউন স্কয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ রোল্যান্ডের মূর্তির চারপাশ ঘিরে বিস্তীর্ণ ওয়াক-ওয়ে আর বিছিয়ে রাখা ক্যানেলের সৌন্দর্য এককথায় মন ভালো করে দেওয়ার মতো!

রোল্যান্ড কেবলই একটি পৌরাণিক চরিত্র নয়, বরং মধ্যযুগীয় ইউরোপে ন্যায়, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও সুশাসনের প্রতীক। মূর্তিটির দিকে তাকালে মনে হবে যেন দাঁড়িয়ে থেকে আজও পাহারা দিচ্ছে রিগার প্রাচীন মূল্যবোধকে।

খানিক দূরেই ব্ল্যাক হেডসের ভবন। লাল-সাদা এই ভবনটি একসময় ছিল ব্যাচেলর বণিকদের সংগঠন ব্রাদারহুড অব ব্ল্যাক হেডসের মিলনস্থল। কয়েক শতাব্দী এই ভবন ছিল রাজনীতি, সংস্কৃতি আর সমাজজীবনের কেন্দ্র। ভবনের দেয়ালে খোদাই করা অগণিত ভাস্কর্য, সোনালি রঙের ঘণ্টাধ্বনি, আর ছাদের কারুকাজ—সবকিছু মিলিয়ে যেন এক জাদুর ঘর।

সত্যি বলতে, রিগা ঘুরে আমার যেটা মনে হয়েছে, এটি শুধুই একটি শহর নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাসের বই। এখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি মূর্তি বা ভাস্কর্য আর প্রতিটি ভবন যেন গল্প বলছিল ঐতিহ্যের, সাক্ষ্য দিচ্ছিল ইতিহাসের।

অবশ্য ভালো লাগেনি রিগার পার্কিং ব্যবস্থা! আমাকে তো রীতিমতো ধকল পোহাতে হয়েছে গাড়ি পার্ক করার জন্য। একে তো নতুন, তার উপর টিকিট খাওয়ার আতঙ্ক- দুইয়ে মিলে নতুনদের জন্য মহা ঝামেলার কাজ। তবে জিনিসপত্রের দাম ফিনল্যান্ডের তুলনায় অনেক কম। এখানে সেলারিও ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম- এমনটাই শুনেছি।

উরমালার উত্তাল সৈকতে ভ্রমণ গল্পের লেখক এহেছান লেনিন।

যতটুকু বুঝেছি, রিগাকে বুঝতে হলে অন্তত এক সপ্তাহ ব্যয় করা উচিত। কবিতা লিখতে, একটা আস্ত রাত, আর দাউগাভার শান বাঁধানো ঘাট! আহা, মগজে লেপ্টে গেল মায়াবী রাতের অন্ধকারে জলে ভেসে ওঠা অর্ধ নগ্ন চাঁদ!

জেনে রাখার জন্য

রিগা-তেই ইউরোপের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আর্ট নুভো ভবন রয়েছে, ৮০০টির বেশি! তাই স্থাপত্যপ্রেমিদের কেউ কেউ রিগাকে স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করেন।

রাশিয়ার প্রথম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন কিন্তু এই রিগায়। ১৮৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রিগা টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি।

রিগা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ১৫টিরও বেশি খাল। তাই এই শহর উত্তরের ভেনিস নামেও পরিচিত।

শীতে রিগায় তাপমাত্রা নামতে পারে -২০ ডিগ্রির নিচে!

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads