বিশ্বের অধিকাংশ নেতার কাছেই বিরল মাটি থেকে পাওয়া ধাতুগুলো এতদিন তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু কয়েক মাস আগে চীন এসব ধাতুর রপ্তানি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পর বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসে।
অবশ্য চীনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নজরে এসব বিরল ধাতু প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে থেকেই আসে।
চীনের শাসক মাও সে তুং দীর্ঘ ২৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি বরাবরই চীনে লোহা ও ইস্পাত উৎপাদন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে তিনি কখনোই সেই ইস্পাতের গুণগত মান নিয়ে খুব একটা চিন্তা করেননি। এর ফলে চীনে প্রচুর পরিমাণে নিম্নমানের লোহা ও ইস্পাত উৎপাদন হয়েছিল, যা শিল্পের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি।
১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের ধাতুবিজ্ঞানীরা নমনীয় লোহার মান উন্নত করার একটি সহজ প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন। এই ধরনের লোহা সাধারণত পাইপলাইন, গাড়ির যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হয়। তারা গলিত অবস্থায় লোহায় সামান্য পরিমাণে বিরল ধাতু সিরিয়াম মেশানোর পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এটিই ছিল বিরল মাটি থেকে প্রাপ্ত ধাতুর প্রথম দিকের শিল্প-ব্যবহার। অন্য অনেক বিরল ধাতুর তুলনায় সিরিয়াম রাসায়নিকভাবে খনিজ থেকে আলাদা করাও তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল।
১৯৭৮ সালে দেং শিয়াওপিং চীনের শীর্ষ নেতা হন। তিনি দ্রুত লোহা ও ইস্পাত শিল্পকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করেন। তিনি ফাং ইয়ি নামক এক অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদকে ভাইস-প্রিমিয়ার এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমিশনের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
নিয়োগের পরপরই ফাং ইয়ি চীনের শীর্ষ ভূতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে যান ইনার মঙ্গোলিয়ার বাওতো শহরে। সেখানে চীনের সবচেয়ে বড় লৌহ খনি ও বিশাল ইস্পাত মিল ছিল। মাও সেতুংয়ের আমলে এই শহরের কারখানাগুলোই চীনের ট্যাংক ও কামানের জন্য ইস্পাত সরবরাহ করত।
কিন্তু ফাং ইয়ির নেতৃত্বাধীন দল একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়—এবার শুধু লোহা নয়, খনি থেকে আরও মূল্যবান কিছু আহরণ করা হবে।
খনিতে প্রচুর পরিমাণে হালকা ধরনের বিরল মাটি-ধাতু মজুত ছিল। এর মধ্যে সিরিয়াম ছিল। এটি নমনীয় লোহা তৈরির পাশাপাশি কাঁচ তৈরি ও প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সেখানে ছিল ল্যান্থানাম নামক আরেকটি ধাতু, যা তেল পরিশোধনে ব্যবহৃত হয়।
খনিতে মাঝারি মানের বিরল ধাতুও ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সামারিয়াম। ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এই ধাতুটি ব্যবহার করে এমন চুম্বক তৈরি করেছিল, যা অতিরিক্ত তাপ সহ্য করতে পারে। এই ধরনের চুম্বক ব্যবহৃত হয়েছিল সুপারসনিক যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের ইঞ্জিনে।
১৯৭৮ সালে বাওতো শহরে সফরের সময় ফাং ইয়ি ঘোষণা করেন, “বিরল ধাতু লোহা, নমনীয় লোহা, কাঁচ, সিরামিক, সামরিক শিল্প, ইলেকট্রনিকস এবং নতুন উপকরণ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।” এই ঘোষণা বাওতো শহরের জাদুঘরের একটি প্রদর্শনীতে এখনও সংরক্ষিত আছে।

সে সময় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নতির পথে ছিল। বাওতো সফরের পরপরই ফাং ইয়ি শীর্ষ চীনা প্রকৌশলীদের নিয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। তারা লস অ্যাঞ্জেলসের কাছে অবস্থিত লকহিড মার্টিন ও ম্যাকডোনাল ডগলাসের অত্যাধুনিক কারখানা পরিদর্শন করেন।
প্রাকৃতিকভাবে বিরল মাটি-ধাতুগুলো একে অপরের সঙ্গে জটিলভাবে যুক্ত থাকে। বিশেষ করে ভারী ধাতুগুলোকে আলাদা করতে বহুবার রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচুর অ্যাসিড ব্যবহার করতে হয়।
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় একই ধরনের প্রযুক্তি তৈরি করেছিল এই ধাতুগুলো আলাদা করার জন্য। কিন্তু এই পদ্ধতিগুলো ছিল ব্যয়বহুল। এতে স্টেইনলেস স্টিলের পাত্র ও পাইপ, সঙ্গে ব্যয়বহুল নাইট্রিক অ্যাসিডের দরকার হতো।
চীন সরকার তাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কম খরচের বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবনের নির্দেশ দেয়। উত্তর আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিরল ধাতু কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহী ও রসায়ন প্রকৌশলী কনস্টানটিন কারায়ান্নোপোলস জানান, চীনের প্রকৌশলীরা প্লাস্টিকের তৈরি সরঞ্জাম ও তুলনামূলক সস্তা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ব্যবহার করে বিরল ধাতু আলাদা করার পদ্ধতি বের করেন।
এই খরচ সাশ্রয়ী পদ্ধতির পাশাপাশি পরিবেশগত বিধিনিষেধ না মানার কারণে চীনের রিফাইনারিগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে অনেক সস্তায় ধাতু তৈরি করতে শুরু করে। এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর পরিবেশ আইন কঠোর হতে থাকায় একের পর এক রিফাইনারি বন্ধ হয়ে যায়।
চীনের ভূতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার করেন যে, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক বিরল মাটি-ধাতুর মজুত রয়েছে চীনে। এর মধ্যে দক্ষিণ-মধ্য চীনে ছিল অত্যন্ত মূল্যবান ভারী বিরল ধাতুর বড় বড় খনি। এই ধাতুগুলো গাড়ির চুম্বক, চিকিৎসা ইমেজিং এবং নানা ধরনের উন্নত প্রযুক্তির কাজে ব্যবহৃত হয়।
১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে চীনের রিফাইনারি প্রকৌশলীরা ভারী বিরল মাটি-ধাতু আলাদা করার জটিল প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করেন। ফলে চীন প্রায় পুরোপুরি এই ধরণের ধাতুর উৎপাদনে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৯২ সালে দেং শিয়াওপিং বলেছিলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে তেল আছে, আর চীনের আছে বিরল মাটি-ধাতু।”
এর আগেই তিনি ও ফাং ইয়ি চীনের বিরল ধাতু শিল্পকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পরবর্তী নেতাকে প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ভূতাত্ত্বিক—ওয়েন জিয়াবাও। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে চীনের বেশিরভাগ শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছিল। তখনও ওয়েন বেইজিংয়ের ভূতত্ত্ব ইনস্টিটিউটে বিরল মাটি-ধাতু নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।
ওয়েন জিয়াবাও ১৯৯৮ সালে ভাইস-প্রিমিয়ার হন। পরে ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চীনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে ইউরোপ সফরের সময় তিনি বলেন, চীনে বিরল মাটি-ধাতু সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণে তার সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া কোনও সিদ্ধান্তই নেওয়া হতো না।
তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস