মনে সংশয় রেখে কেন ভোটের ঢাকে বাড়ি দিল বিএনপি?

নাটোরে বিএনপির সমাবেশে কর্মীরা। রোববারের এই সমাবেশেও ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে প্রচার চালানো হয়।
নাটোরে বিএনপির সমাবেশে কর্মীরা। রোববারের এই সমাবেশেও ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে প্রচার চালানো হয়।

আওয়ামী লীগ শূন্য রাজনীতির মাঠেও বেকায়দায় আছে বিএনপি- এটা এখন সব মহলেই আলোচনায়। মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ যে মনমতো হয়নি, তা বলতে রাখঢাক করছে না দলটির নেতারা। তারমধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও জুলাই অভ্যুত্থানকারীদের দল এনসিপিও রয়েছে বিএনপির বিরোধিতায়।

বিএনপি কতটা বেকায়দায় রয়েছে- সেই প্রশ্ন বিবিসি বাংলা রেখেছিল দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনক। তিনি বলেছেন, ঐকমত্য কমিশন যা করেছে, তা কেবল বিএনপিকে নয়, পুরো জাতিকেই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।

সরাসরি না হলেও তিনিও এক রকম স্বীকার করে নিলেন যে বিএনপি কিছুটা হলেও বেকায়দায় রয়েছে। গণভোট আগে, না সংসদ নির্বাচন আগে? জোটের প্রার্থীরা কি ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নিতে পারবে? এমন সব জট ছাড়ানোর আগেই আকস্মিক সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা সোমবার ঘোষণা করে দিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের খবর জানলেও প্রার্থী ঘোষণা হবে, এমন খবর সাংবাদিকদেরও জানা ছিল না। ফলে তাদের কাছে বিষয়টি ছিল অপ্রত্যাশিত।

প্রত্যাশিত হওয়ার কথাও ছিল না। কারণ তার একদিন আগেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছিলেন, পরিস্থিতি যে এমন হবে, তা তার ভাবনায় ছিল না। লন্ডন থেকে এমন কথাও তিনি বলেছিলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে কোনো কোনো সময় জনমনে প্রশ্ন বাড়ছে—যথাসময়ে কি নির্বাচন হবে?”

আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ দেয়ার পর মতৈক্য সৃষ্টির বদলে মতানৈক্য বেড়েছে। জামায়াত গণভোট আগে চাইছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইছে, একদল আরেক দলের প্রতীকে ভোট করতে পারবে না, তাও চাইছে। এইসব দাবিতে ইসলামী দলগুলোকে এক করেছে তারা, যাদের কয়েকটি আগে বিএনপির জোটে ছিল। এনসিপিও অনেকটা সেদিকেই হাঁটছে। বিএনপি এর কোনোটিই চায় না।

এই সংকটের সমাধান কী, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। সোমবার উপদেষ্টা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসেছিল। এরপর সংবাদ সম্মেলনে এসে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানালেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে তারা আর বসতে রাজি নন। এখন মতৈক্য প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দলগুলোকেই নিতে হবে।

দলগুলো যদি এক সপ্তাহের মধ্যে সংবিধান সংস্কারসহ নির্বাচনের বিষয়ে একমত না হয়, তাহলে সরকার নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে, তাও জানালেন তিনি। কমিশনের প্রধান যেহেতু ছিলেন ইউনূস, তাতে তার সরকার নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিলে তা যে বিএনপির মনের মতো হবে না, তা বোঝাটা কারো জন্যই কঠিন নয়।

দুপুরে এই সংবাদ সম্মেলনের পরই সন্ধ্যায় হঠাৎ করে নির্বাচনের প্রার্থী তালিকার ঘোষণা দিল বিএনপি, যার মধ্য দিয়ে আসলে ভোটের ঢাকে বাড়িই মারা হলো।

কিন্তু কেন?  বিশ্লেষকরা বলছেন, হয়ত জনগণকে নির্বাচনমুখী করতে চাইছে বিএনপি, যাতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। সরকার অন্য পথে যেন যেতে না পারে।

সরকার যে ভিন্ন পথ খুঁজতে চাইছে, তা তারেক রহমান রোববারের বক্তব্যেই বলেছিলেন। তার ভাষ্যে, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যথাসাধ্য সম্ভব আমাদের অবস্থান থেকে আমরা সহযোগিতা করে আসছি। অথচ আমরা দেখছি, একের পর এক নতুন শর্ত জুড়ে দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সংকটাপন্ন করে তোলা হচ্ছে। এর পরিণতি সম্পর্কেও আমাদের সতর্ক থাকা অবশ্যই প্রয়োজন।”

জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত বছরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের শঙ্কা তারা করছেন। আওয়ামী লীগ মাইনাস হয়েছে, এখন বিএনপিকেও মাইনাস করার চক্রান্ত রয়েছে।

কিন্তু ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর বিএনপি নির্বাচনটি পেতে অন্তর্বর্তী সরকারকে একের পর এক ছাড় দিয়েই যাচ্ছে। এখন কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচনটি যদি আটকে যায়, সেই ভয়ই পাচ্ছে বিএনপি।

বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে কমিশনের সুপারিশমালাকে হাতিয়ার করছে সরকার। এই ভেবে বিএনপিও ভোটের পথে এগিয়ে সরকারকে পাল্টা চাপে ফেলতে চাইছে, এমনটা মনে করেন অনেকে।

কিন্তু সোমবার প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরপরই বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে বিএনপির মনোনয়ন না পাওয়াদের। সড়ক অবরোধ, ভাংচুরের ঘটনাও ঘটছে। ফলে এই প্রশ্নও উঠছে, বিএনপির এই কৌশল বুমেরাং হয়ে যায় কি না?

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads