অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ শুনছে ইসলামী দলগুলোর কিংবা ধর্মীয় নেতাদের উচ্চ রব; দেখছে তাদের প্রভাব। গান, নাচের অনুষ্ঠান বন্ধ, মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ, পর্দা না করার কথা বলে নারীদের হেনস্থা, ধর্মবিরোধী বলে পাঠাগার থেকে বই তুলে নিয়ে যাওয়া; এমন সব কিছুর পর এবার গাছও রেহাই পাচ্ছে না।
প্রাকৃতিক অনেক ঝড় সামাল দিয়ে আসছিল মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলার শিড়খাড়া ইউনিয়নের আলম মিরের কান্দি এলাকার একটি বটগাছ। শতবর্ষী গাছটি এবার ধর্মের ঝড় সামাল দিতে পারল না। ‘শিরক’ আখ্যায়িত করে গত সোমবার গাছটি কেটে ফেলেছে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
গাছ কাটার ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। মূল গাছটি রক্ষা করা গেলেও শাখা প্রশাখা বাঁচানো যায়নি।
ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন বুধবার গাছটির মালিককে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, গাছটি এলাকার একটি মাদ্রাসার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, গাছ কাটার কুমার নদের খেয়া ঘাটের বটগাছটি ঘিরে ‘পূজা-মানতের মত শিরক কাজ হচ্ছে’ বলেই এটি কাটা শুরু হয়েছিল।
ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, ‘মুসল্লি’ পরিচয়ধারী একদল ব্যক্তি করাত দিয়ে বিশাল বটগাছটির বিভিন্ন অংশ কাটছেন।
নদীর পাড়ের গাছটিকে এলাকার অনেকে পবিত্র জ্ঞান করত বলে স্থানীয়দের ভাষ্যে জানা যাচ্ছে। তবে এতদিন ধরে তা নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি।
স্থানীয় সদ্য সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দীর্ঘকাল ধরেই দেখছি, কেউ এর ছায়ায় আশ্রয় নেয়, আবার কেউ বা মানত করে, শিন্নি দেয়। কেউ প্রার্থনা করে। কেউ লাল কাপড় বাঁধে।
“এনিয়ে কোনোদিন কারও সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন একদল বলছে- এগুলো সব শিরক। এলাকাবাসী দেখেছে, তারাই গাছ কেটেছে।”
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তবে গাছটি কাটার কারণ শুধু ধর্মীয় বিষয় বলে মানতে নারাজ স্থানীয় কেউ কেউ। তারা বলছেন, গাছটি বিক্রি করতে এর মালিককে বাধ্য করার জন্য ধর্মীয় বিষয়টি সামনে এনে পুরো ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
গাছ কাটার পর তৎপর হওয়া স্থানীয় প্রশাসন বুধবার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে। সেখানে ইউএনও ওয়াদিয়া শাবাবসহ জেলা বন কর্মকর্তা, র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারাও ছিলেন।
যে জমিতে গাছটি, তার মালিক সাত্তার হাওলাদার ছিলেন সেই সংবাদ সম্মেলনে। শ্রীনদী বাইতুস সুন্নত ক্যাডেট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান মাতুব্বরও উপস্থিত ছিলেন, যারা গাছটি কেনার দাবি করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “কারো ব্যক্তিগত জমিতে থাকা কোনো বৃক্ষ জমির মালিক বিক্রি বা কর্তন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলে আইনগত তেমন বাধা নেই।”
এরপর গাছের মালিক সাত্তার হাওলাদার লিখিত বক্তব্য পাঠ করার সুরে বলেন, “যেখানে বটবৃক্ষ রয়েছে, সেই জমিতে আমি নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য দীর্ঘদিন ধরেই বটগাছটিকে বিক্রি করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বটগাছটি কর্তন করতে অনেক বেশি টাকা খরচ হবে বিধায় কেউ কিনতে আগ্রহী ছিলেন না।
“পরে আমি নামমাত্র মূল্যে শ্রীনদী বাইতুস সুন্নত ক্যাডেট মাদ্রাসার কাছে গাছটি বিক্রি করে দেই।”
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান মাতুব্বর বলেন, “আমরা সাত্তার হাওলাদারের কাছ থেকে বটগাছটি মাদ্রাসায় ব্যবহারের জন্য ক্রয় করি। এবং খরচ কমানোর জন্য নিজেদের লোকজন নিয়ে কর্তন করি।”
বিষয়টি গাছ কেনা-বেচার বললেও জেলা বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি করেছে প্রশাসন। তিন সদস্যের কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
ইউএনও ওয়াদিয়া বলেন, “প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে যদি আইনগত কোনো পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়, সেই দিকটা দেখব।”
এর আগে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে ‘ধর্মবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে একটি পাঠাগার থেকে পাঁচটি বস্তায় করে বই তুলে নিয়েছিল একটি ইসলামী সংগঠনের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।
কয়েকদিন আগে কুড়িগ্রামের একজন শিক্ষকের পর্দা নিয়ে ফেইসবুক পোস্টের জের ধরে সালিশ করে তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়।
গত বছরের আগস্টের পর ‘ধর্মবিরোধী’ কর্মকাণ্ডের অজুহাত দিয়ে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। বিশেষ করে মাজারে হামলার অন্তর্বর্তী সরকার কড়া হুঁশিয়ারি দিলেও এমন সব ঘটনা থেমে নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম খাদেমুল হক এসব ঘটনাগুলোকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রকাশ হিসাবেই দেখছেন।
কারণ হিসাবে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তারা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে এবং তাদের এসব ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে দেখা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে উগ্রপন্থার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার বিষয়টি আসে।
সরকার সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও বিক্ষুব্ধ মুসল্লি কিংবা তৌহিদী জনতার ব্যানারে দেশে নানা ঘটনা ঘটেই চলেছে।
অন্যদিকে ইসলাম বিষয়ক লেখক ও বিশ্লেষক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ অবশ্য এসবকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বলতে নারাজ।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটিকে ঠিক ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বলা যাবে না, বরং ধর্মীয় অঙ্গন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি ‘অতি অধিকার বোধে’র বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
“ধর্মীয় অঙ্গনে যারা করে, তারা তৌহিদী জনতা নাম নিয়ে করছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য ক্ষেত্রে হয়ত ভিন্ন নামে করছে।”
তিনি বিষয়টির ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এভাবে- “যেহেতু আন্দোলনের মাধ্যমে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়েছে, তাই তাৎক্ষণিক আন্দোলনে সবকিছু সমাধান করার একটি প্রবণতা চলছে। তারা নিজের মতো করে সমাধানের চেষ্টা করছে। আমার ধারণা তেমনি একটি পরিস্থিতি চলছে।”
তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খাদেমুল হক বলেন, “কিছু মানুষের মধ্যে এমন ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের পর তারা এখন বেশি প্রকাশ্যে আসছে।
“যারা এগুলো করছে, তারা নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্যই করছে এবং তারা কোনোভাবেই ধর্মপ্রাণ মানুষদের প্রতিনিধিত্বও করে না।”