২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বাড়ছে অন্ত্রের ক্যান্সার; যা একসময় বেশি চোখে পড়তো উন্নত দেশগুলোতে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইদানিং মধ্য এবং নিম্ন আয়ের দেশেও এ ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
দ্রুত নগরায়নের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন এতে ভূমিকা রাখছে- এমনটি বলছেন গবেষকরা।
মলাশয়ে ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ছে যুক্তরাজ্য, চিলি ও নিউজিল্যান্ডে তরুণদের মধ্যে। প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে বয়স্কদের রোগ বলে ভেবে আসা এই ক্যান্সারে বিশ্বব্যাপী তরুণ প্রজন্ম কেন আক্রান্ত হচ্ছে?
দেখা গেছে অনূর্ধ্ব ৫০ বয়সীদের মধ্যে অন্ত্রে ক্যান্সার শনাক্তের ঘটনা দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, চিলি ও নিউজিল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি।
অন্ত্রের ক্যান্সার মলাশয় ক্যান্সার নামেও পরিচিত। বৃহদান্ত্রে টিউমার থেকে হয় যার সঙ্গে মলদ্বার ও কোলনও সম্পৃক্ত।
যত ধরণের ক্যান্সার শনাক্ত হয় তার মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ হচ্ছে অন্ত্রের ক্যান্সার। আর ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এটি। ২০২২ সালে এই রোগে ১ দশমকি ৯ মিলিয়ন লোক আক্রান্ত এবং নয় লাখ চার হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউিএইচও) এর অনুমান ২০৪০ এর মধ্যে এই ক্যান্সারে বছরে ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন লোক আক্রান্ত হবে।
মেডিকেল জার্নাল ‘দ্য লানসেট অনকোলজি’ তে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণরাই এই ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
২০১৩ থেকে ২০১৭, পাঁচ বছর ধরে চালানো এ গবেষণায় দেখা গেছে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিবছরই তাৎপর্যপূর্ণ হারে বাড়ছে। এ বাড়ার হার নিউজিল্যান্ডে প্রতি বছর ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, পুয়ের্তো রিকোতে ৩ দশমকি ৮১ শতাংশ এবং ইংল্যান্ডে ৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এই ক্যান্সার আগে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো উচ্চ আয়ের দেশে বেশি দেখা যেত । কিন্তু সম্প্রতি আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, থাইল্যান্ড এবং তুরস্কে বাড়ছে। যার মানে ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার মতো নিম্ন আয়ের অঞ্চলেও এই ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
এছাড়া জাপান, চিলি, ইসরায়েলের মতো দেশ যাদের বিগত কয়েক দশক ধরে দ্রুত নগরায়ন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে সেসব দেশের তরুণদের মধ্যে অন্ত্রে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তন এবং যার ফলে মানব অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার (গাট ব্যাকটেরিয়া) বদলে যাওয়াই অন্ত্রের ক্যান্সার বৃদ্ধির কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তার সঙ্গে অধিক পরিমাণে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জাংক ফুড খাওয়া, শুয়ে-বসে থাকাও কারণ। প্রজন্মগত পরিবর্তনজনিত খাদ্যাভ্যাসও অন্ত্রের ক্যান্সার বাড়ায় ভূমিকা রাখছে। যেমন ১৯৫০ এর পর উচ্চ আয়ের দেশে জন্ম নেওয়া অনেকেই অল্প বয়সেই উচ্চ চর্বি, উচ্চ চিনি এবং কম আঁশযুক্ত খাবারে অভ্যস্থ হয়।
এই খাবারগুলোতে প্রতিরক্ষামূলক পুষ্টির উপাদান যেমন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবারের অভাব রয়েছে; যা অন্ত্র কোষকে স্বাস্থ্যকর রাখতে সাহায্য করে এবং ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর অ্যাসিড যা উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবারের পচন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়, সেগুলিকে নিষ্কাশন করতে সহযোগিতা করে। খাদ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং আঁশ না থাকায় ক্ষতিকর অ্যাসিডগুলি অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির উৎস হয়।
এছাড়াও অন্ত্রের প্রাকৃতিক মাইক্রোবায়োমের পরিবর্তন এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই প্রভাব পুরোপুরি বোঝার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম হচ্ছে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস ও অণুজীব যা মানুষের পাচনতন্ত্রে বাস করে এবং হজম ও রোগপ্রতিরোধে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অন্ত্রের ক্যান্সারের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মলদ্বারের রক্তপাত, পেটে ব্যথা, অন্ত্রের অস্বাভাবিকতা যেমন-ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া।
অন্ত্রের ক্যান্সারের জন্য যেসব কারণ দায়ী তার মধ্যে জীবনযাপন, বংশগতি এবং পরিবেশেন প্রভাব থাকলেও বেশিরভাগ আক্রান্তের ঘটনা জীবনযাপনের সাথে সম্পৃক্ত। এছাড়া মদ, মাংস বিশেষ করে লাল ও প্রক্রিয়াজাত মাংস এবং অতিরিক্ত ওজনও অন্ত্রে ক্ষতিকারক অ্যাসিড উৎপাদন করে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
আক্রান্তের কোন পর্যায়ে গিয়ে ক্যান্সার শনাক্তে ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে। যত দ্রুত শনাক্ত হয় চিকিৎসায় তত ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রথম স্টেজে শনাক্ত হলে ৯০ শতাংশের বেশি আক্রান্ত পাঁচ বছর বা তার অধিক সময় বেঁচে থাকে। অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে এ হার কমতে থাকে, আর যদি চতুর্থ স্টেজে গিয়ে শনাক্ত হয় তবে পাঁচ বছরের বেশি বেঁচে থাকার হার ১০ শতাংশের মতো। ক্যান্সার আক্রান্তের পর কে কতদিন বেঁচে থাকবে যদিও এটা বলা প্রায় অসম্ভব।
আগে যেখানে পঞ্চাশোর্ধ্বদের মধ্যে এই ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি দেখা যেত এখন তা পরিবর্তিত হয়ে ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো উচ্চ আয়ের দেশে।
এর মধ্যে যুক্তরাজ্য এবং নরওয়ে পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তবে তরুণদের মধ্যে এই ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও পঞ্চাশোর্ধ্বরাই এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তন এবং নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই ঝুঁকি অনেক কমিয়ে দিতে পারে। ৪৫ বছর বয়সের পর থেকে নিয়মিত কোলোনস্কোপি এবং মল পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াসহ আরও অনেক দেশের চিকিৎসকরা। এছাড়া উপসর্গ বিষয়ে সতর্কতা এবং ক্যান্সারের পারিবারিক ধারা সম্পর্কে সচেতনতায় প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুফল আনবে বলেও জানান তারা।
সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মদ্যপান, ধূমপান বাদ দিয়ে নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে এ ঝুঁকি কমানো যায়।
আল জাজিরা অবলম্বনে