রাখঢাক ছেড়ে বিএনপি-বৈষম্যবিরোধী মুখোমুখি

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছিল আগে থেকে, বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে বিএনপির শেষ পর্যন্ত বেঁধেই গেল, কুয়েট হয়তো উপলক্ষ মাত্র। ছাত্রদলের সঙ্গে মারামারির পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বৈষম্যবিরোধীদের প্রতি হুঙ্কার দিয়েছেন। বিএনপি নেতারা তাদের এক সময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে নিয়েও হচ্ছেন সমালোচনামুখর।

অভ্যুত্থানের ছয় মাস গড়ানোর পর রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা আর অস্বস্তি টের পাওয়ার কথা বুধবারই এসেছিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত পত্রিকাটির উপ-সম্পাদকের এক কলামে। আর সেদিনই নানা বক্তব্যে গরম হয়ে উঠল রাজনীতির মাঠ। আওয়ামী লীগশূন্য এই মাঠে এখন বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখা যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের পাশাপাশি জামায়াতকে।

আর তা ঘটছে তখন, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ঘটা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে জুলাই অভ্যুত্থানের সনদ তৈরিসহ সংস্কারের বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই।

গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যখন শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটেছিল, সেই আন্দোলনে এক সঙ্গেই ছিল বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য পক্ষগুলো। তবে তারপরই ছোটখাটো নানা বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধীদের এবং জামায়াতের মতভেদ প্রকাশ পেতে থাকে।

তখন অবশ্য বিএনপির সুর ছিল নরম; বিপরীতে অভ্যুত্থানের জোশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এমন হুঙ্কারও দিয়েছিলেন- “শেখ হাসিনারেই থোড়াই কেয়ার করেছি, আপনারা কি হনু রে।”

কিন্তু যতই দিন গড়িয়েছে, দুই পক্ষের দূরত্ব ততই বাড়ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এই আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক কমিটি যখন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেয়, তখন থেকেই উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে।

মির্জা ফখরুল ক্ষমতায় থেকে ছাত্রদের নতুন দল গঠনের উদ্যোগের সমালোচনা করলে তার জবাবে তাকে হুঁশিয়ার করেন অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে উপদেষ্টা হওয়া নাহিদ ইসলাম। তবে তখনও দুজন বলেছিলেন, তাদের মধ্যে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু বিরোধ নেই।

এরপর ছাত্রদের দল গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলার মধ্যে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে নতুন এই দলের সঙ্গে তাদের নির্বাচনী সমঝোতারও ইঙ্গিত দেন। বড় দল হলেও রাজনীতির মাঠে এখন অনেকটা একা থাকা বিএনপির নেতারা তাও দেখছেন সন্দেহের চোখে।

এরমধ্যেই গত বুধবার খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সঙ্গে লেগে যায় বৈষম্যবিরোধীদের। ছাত্রদলের অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধীদের ছত্রছায়ায় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরই এই মারামারি বাঁধিয়েছে।

তারপর দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ও আগে ছাত্রশিবিরের নেতাদের পরিচয় লুকিয়ে ছাত্রলীগে ভিড়ে কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে সংগঠনটিতে গুপ্ত সংগঠন আখ্যায়িত করেন ছাত্রদলের নেতারা। শিবির নিষিদ্ধের দাবিও তোলেন তারা।

ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রদলের নেতারা বলেন, কুয়েটে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারের আড়ালে লুকানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের গুপ্ত কর্মীরা এবং নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা মিলে ছাত্রদলের ওপর চড়াও হয়েছে।

তারা অভিযোগ তোলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুয়েট শাখার আহ্বায়ক ওমর ফারুকের নেতৃত্ব দিয়েছেন এই হামলায় এবং ঢাকা থেকে তা মনিটর করেন প্ল্যটফর্মেস আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।

কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলে বৈষম্যবিরোধীদের কমিটি কীভাবে গঠিত হয় কিংবা ছাত্রশিবির কীভাবে কাজ চালায়, সেই প্রশ্নও তুলেছেন ছাত্রদেলের নেতারা।

অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম সংগঠনের ফেইসবুক পাতায় এক পোস্টে বলেন, “বন্ধুপ্রতিম সংগঠনটি আমাদের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বিগত ফ্যাসিস্ট ও তাদের শাহবাগী দোসরদের পরামর্শে অগ্রসর হচ্ছে।”

অর্থাৎ অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোই এখন একে অন্যকে ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা দিচ্ছে; যা দিয়ে এতদিন অন্যদের শায়েস্তা করা চলত।

এরমধ্যে হাসনাত আব্দুল্লাহ এক ফেইসবুক পোস্টে ছাত্রদলকে ইঙ্গিত করে লিথেছেন- “যে ছাত্রলীগ হয়ে উঠতে চাইবে, তার পরিণতি ছাত্রলীগের মতোই হবে।”

তার আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ ফেইসবুকে লেখেন, “কুয়েটে ছাত্রদল নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ স্টাইলে যে নৃশংস হামলা চালাচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদল নিজেদের রাজনৈতিক কবর রচনার পথেই অগ্রসর হলো।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজেও ‘ছাত্রদলের সন্ত্রাস’ রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।

এই পাল্টাপাল্টি চলার মধ্যেই বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ঢাকায় এক আলোচনা সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে হুঁশিয়ার করে বলেন, সরকারে বসে সরকারের সব সুযোগ–সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করলে তা কখনোই মেনে নেওয়া হবে না।

এবিষয়ে ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সেইসঙ্গে বলেন, তা না হলে সরকার জনগণের আস্থা হারাবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে তিনজন উপদেষ্টা হয়ে এখন অন্তর্বর্তী সরকারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম নতুন রাজনৈতিক দলে নেতৃত্ব দেবেন বলেই শোনা যাচ্ছে। এই মাসেই নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হওয়ার কথা রয়েছে।

গত মাসে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের কথাটির প্রাসঙ্গিকতা বুধবারের সভায়ও তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল।

সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারলে নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। তখন আরেকটি নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।

“কেন বলেছিলাম, তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে,” বলেন বিএনপি মহাসচিব।

ছাত্রদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা হওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দুদিন আগে বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমা চেয়ে রাজনীতিতে ফিরতে পারে।

নির্বাচন আয়োজনে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ফখরুল বলেন, “তারা এখন তাদের নিজেদের স্বার্থে ফ্যাসিস্টদের জায়গা দিতে চায়। এই কথাটা কালকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেছেন। হুইচ ইজ ডেঞ্জারাস। তার মানে কি আমরা এটা মনে করব, তারা সরকারে থেকে তাদের দল গোছানোর জন্য বিভিন্ন রকম কৌশল নিচ্ছেন? সেই কৌশল নিলে আমরা তা হতে দেব না।”

এই কথা বলেই সভায় উপস্থিত ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এটা কি আপনারা মেনে নেবেন?” ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা সমস্বরে জবাব দেয়- “না।”

অভ্যুত্থানের শক্তিদের এখনকার বিরোধের কারণ চিহ্নিত করে প্রথম আলোর উপ-সম্পাদক এ কে এম জাকারিয়ার কলামে বলা হয়, “কেন এই অনিশ্চয়তা ও অস্বস্তি? সাধারণভাবে উত্তরটি হচ্ছে, সবাই এখন নিজ নিজ চাওয়া-পাওয়া নিয়ে এগোতে চাচ্ছে এবং গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর এই চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে।”

কখন নির্বাচন, কোন পর্যন্ত সংস্কার বা সরকারের মেয়াদ—এসব নিয়ে অভ্যুত্থানের পক্ষগুলোর মধ্যে বড় মতপার্থক্যের কথাও বলেন তিনি।

“দেশের বর্তমান রাজনীতিতে বেশ কিছু পক্ষের ভূমিকা থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রসমাজ ও সবচেয়ে বড় সহায়ক রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিকে কেন্দ্র করেই বাকি পক্ষগুলোর হিসাব-নিকাশ চলবে। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিএনপির যেকোনো বিরোধ, ভুল-বোঝাবুঝি বা সন্দেহ-অবিশ্বাস তাই দেশের রাজনীতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। তার কিছু লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে মৌলিক ও ন্যূনতম কিছু ইস্যুতে মতৈক্যে আসার কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়বে,” লিখেছেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

সরকারে থেকে দল গোছাতে দেব না, ফখরুলের হুঁশিয়ারি

ফখরুলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধীদের তরজা দিচ্ছে বিরোধের বার্তা

আরও পড়ুন