যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্তদের সকালের নাস্তার পাতে ডিম একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। কিন্তু সেই ডিম নিয়েই দেশটিতে গত কয়েক বছর ধরে চলছে সঙ্কট। যত দিন যাচ্ছে সঙ্কট তত বাড়ছে। বছরের পর বছর বেড়েই চলেছে ডিমের দাম। ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্তদের হাতের নাগালের বাইরে যাচ্ছে ডিম।
সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগের প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ডিমের দাম কমানোর কথা তিনি বারবার বলে এসেছেন। কিন্তু গত ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর এখনও দেশটিতে না কমেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, না কমেছে ডিমের দাম।
পরিস্থিতি এমন যে ম্যাসাচুসেটসের কিছু বাজারে দোকানদাররা পরিবারপ্রতি দুই কার্টুনের বেশি ডিম কিনতে নিরুৎসাহিত করছে। লাস ভেগাসে এক ক্রেতা দোকানে গিয়ে দেখেন সেখানে কোনো ডিম নেই। সোশাল মিডিয়ায় একজন জানান, আগে যেখানে ২ ডলারে এক ডজন ডিম পাওয়া যেত, এখন দ্বিগুনের বেশি দামেও ডিম পাওয়া যাচ্ছে না।
এই দৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রে হঠাৎ করে হয়েছে এমন না। সাবেক বাইডেন প্রশাসন থেকেই এই অবস্থার শুরু। তখন থেকেই দেশটির দোকানগুলোতে ডিমের সঙ্কট দেখা গিয়েছিল। নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে সেই সঙ্কট আরও প্রকট হয়েছে। বলা হচ্ছে, এবছর দেশটিতে ডিমের দাম আরও বাড়তে পারে। ক্রেতাদের এখন ডিম আগের বছরের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে দেশটিতে মোট ৯ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডিম উৎপাদন হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৩ শতাংশ কম। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ছিল খাবার উপযোগী ও ১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ছিল বাচ্চা ফোটানোর ডিম। বাচ্চা ফোটানোর ডিমের মধ্যে ১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ছিল ব্রয়লার জাতের, আর ৯৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন ছিল অন্য জাতের।
দেশটিতে সাধারণত ছুটির মৌসুমে, বিশেষ করে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ডিমের চাহিদা বাড়ে। তখন বেকিংয়ের জন্য ডিমের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চাহিদা অনুসারে ডিম সরবরাহ করতে পারছে না খামারিরা।
তবে এটাও ঠিক যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের ব্যবহার গত দুই দশকে ধীরে ধীরে বেড়েছে। ইউনাইটেড এগ প্রডিউসারদের মতে, ২০০০ সাল থেকে প্রত্যেক আমেরিকানের ডিম খাওয়ার হার প্রায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে।
ডিম সঙ্কটের কারণ
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট গত ২৮ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে ডিমের দাম না কমার দায় দিয়েছেন জো বাইডেনের ‘মূল্যস্ফীতির নীতিকে’।
লেভিট জানান, বাইডেন প্রশাসন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের সিদ্ধান্তের ফলে ১০ কোটির বেশি মুরগি নিধন করা হয়েছে। ফলে দেশে মুরগির সংখ্যা কমে গেছে। এতে ডিমের উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছে, যা সঙ্কটের প্রধান কারণ।
লেভিটের বক্তব্য আংশিকভাবে সত্য। তবে তিনি ঘটনার পূর্ণ বিবরণ ও প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেননি। প্রথমত, মুরগিগুলো নিধন করা হয়েছিল মারাত্মক বার্ড ফ্লু ছড়ানো ঠেকানোর জন্য। দ্বিতীয়ত, এটি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের দীর্ঘদিনের নীতি। বার্ড ফ্লু শনাক্ত হলে পুরো খামারের মুরগি নিধন করা হয়। এই নীতি ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসনের সময়ও কার্যকর ছিল।
হোয়াইট হাউসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আনা কেলি পলিটিফ্যাক্টকে জানান, লেভিটের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যই বর্তমান প্রশাসনের অবস্থান।

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাইডেনের সময়ে ডিমের দাম বেড়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ১ দশমিক ৬০ ডলার। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে ৪ দশমিক ১০ ডলারে পৌঁছায়। কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) জানুয়ারির মূল্য পূর্বাভাস অনুসারে, এ বছর ডিমের দাম আরও ২০ শতাংশ বাড়তে পারে।
বাজারমূল্য বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এক্সপানার মুখপাত্র অ্যাক্সিওসকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকায় এক ডজন বড় ডিমের দাম ৭ ডলারেরও বেশি।
গত অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, ইন্ডিয়ানা, আইওয়া, মিসৌরি, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহিও, ওরেগন, ইউটাহ ও ওয়াশিংটনে বার্ড ফ্লুর খবর পাওয়া গেছে। এটি ৩৬ মিলিয়নেরও বেশি ডিম দেওয়া মুরগিকে প্রভাবিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৩০৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডিম দেওয়ার মুরগি রয়েছে। এর মানে হলো, মাত্র ৪ মাসে উৎপাদকরা মোট ডিম দেওয়ার মুরগির প্রায় ১২ শতাংশ হারিয়েছে।
ইউএসডিএ’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি বাণিজ্যিক খামারে ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ১৪৭ মিলিয়নের বেশি পাখি মারা গেছে। এতে মুরগি, টার্কি, হাঁস ও রাজহাঁস অন্তর্ভুক্ত।
ইউএসডিএ জানায়, ২০২২ সালের পর থেকে ১০৮ মিলিয়ন ডিম পাড়ার মুরগি মারা গেছে। এর মধ্যে ২০২৫ সালের শুরুতেই মারা গেছে ১৩ মিলিয়ন। তবে এদের কতগুলো ভাইরাসে মারা গেছে ও কতগুলো নিধন করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। গত ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৬টি অঙ্গরাজ্যের ৯৪৪টি গবাদিপশুর খামারে বার্ড ফ্লু শনাক্ত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) জানিয়েছে।
আমেরিকান ভেটেরিনারি মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, বার্ডফ্লুতে আক্রান্ত গবাদিপশুর ক্ষেত্রে গড় মৃত্যু ও নিধন হার ২ শতাংশ বা এর কম।
ক্যাল পলি স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাগ্রিবিজনেসের অধ্যাপক রিকি ভলপে সিবিএস মানিওয়াচকে বলেন, “প্রায় দেড় বছর ধরে, যুক্তরাষ্ট্রের পোলট্রি এবং ডিম সরবরাহ চেইনে বার বার ও মারাত্মকভাবে বার্ড ফ্লু দেখা দিয়েছে। সবাই আশা করছে, এটা শেষ হবে। এরপর আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবো। কিন্তু আমরা এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি।”
দাম বাড়ার অন্য কারণ
ডিমের দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাক চালকের অভাব। এই সমস্যা বাড়ছে কারণ অনেক চালক অবসর নিচ্ছেন। ডিম পরিবহন করতে চালক কম থাকায়, পাইকারি বিক্রেতাদের পরিবহন খরচ বাড়াতে হচ্ছে।
অধ্যাপক রিকি ভলপে বলেন, “খাদ্য সরবরাহ চেইনে বর্তমানে ট্রাক পরিবহন একটি বড় সমস্যা। চালকের অভাব ও দীর্ঘ যাত্রার কারণে ট্রাক ভাড়া বেড়ে গেছে। আর ডিম পরিবহনও অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ। বার্ড ফ্লু মোকাবেলা করার আগেও, ডিম সময়মতো পৌঁছানোর জন্য ট্রাক পর্যাপ্ত ছিল না।”

যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সমস্ত ডিম খাঁচায় রাখা যাবে না বলে আইন রয়েছে। এই কারণে ডিমের দাম আরও বেড়েছে।
ডিম সঙ্কট সমস্যার একটি অংশিক সমাধান হিসেবে ভলপে বিক্রেতাদের স্থানীয়ভাবে ডিম সরবরাহকারী থেকে ডিম সংগ্রহ করতে পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, “স্থানীয় সরবরাহকারীরা বার্ড ফ্লু বা অন্যান্য সমস্যা থেকে কিছুটা সুরক্ষিত। তাই সরবরাহ ভালো থাকে। তাই স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে সরবরাহ বাড়ানো উচিত, যারা এই ধরনের বড় সমস্যা মোকাবেলা করছে না।”
মূল্যস্ফীতি চাপ বাড়াচ্ছে। কৃষকরা খাবার, জ্বালানি ও শ্রমের জন্য বেশি দাম দিচ্ছেন। কৃষি খাতে সাধারণ উৎপাদন খরচ দ্রুত বাড়ছে।
এছাড়া ২০২৫ সালে অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডো, ম্যাসাচুসেটস, মিশিগান, নেভাদা, ওরেগন ও ওয়াশিংটনে পশু কল্যাণের কারণে সাধারণ ডিম উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করার আইন চালু করেছে। এতেও ডিমের উৎপাদন কমেছে।
নীতিগত সমস্যা!
কিছু পশুচিকিৎসক মনে করেন, অসুস্থ পাখি নিধন বা ‘স্ট্যাম্পিং আউট’ একটি পুরনো নীতি। এক্ষেত্রে তারা ২০১৫ সালে বারাক ওবামা প্রশাসনের আমলে বার্ড ফ্লু প্রাদুর্ভাবের উদাহরণ দেন।
আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও পশুচিকিৎসক ইউকো সাটো জানান, পোলট্রি ফ্লুর নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্য ইউএসডিএ’র মূল কৌশল হল নিধন।

মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির পশুচিকিৎসক অধ্যাপক ও বার্ড হেলথ চেয়ার ক্যারল কারডোনা বলেন, “এটি অত্যন্ত বিধ্বংসী প্রবণতা । কারণ ২০২২ থেকে অনেক বেশি জায়গা এতে আক্রান্ত হয়েছে। তবে এই নিয়মটি অনেক দিন ধরে রয়েছে।”
ইউএসডিএ’র ২০১৬ সালের রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৫ সালে পাখি নিধন ঘটিয়ে ৫০ মিলিয়ন পাখি মারা যায়।
২০১৭ সালের মে মাসে ট্রাম্পের প্রথম আমলে হালনাগাদ হওয়া ইউএসডিএ’র বার্ড ফ্লু প্রতিকার পরিকল্পনায় ওবামা ও প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ের ফ্লু প্রাদুর্ভাবের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতে বলা হয়, “আক্রান্ত পোলট্রি দ্রুত নিধন করা অত্যন্ত জরুরি। এতে ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ করা যায় এবং এটি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।” ২০১৭ সালে প্রায় ২ লক্ষ ৫৩ হাজার পাখি নিধন করা হয়েছিল।
কোনো কৃষকের খামারে গবাদিপশু অসুস্থ হলে ইউএসডিএ’র পশুচিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করাই নিয়ম। সেই চিকিৎসক পরীক্ষা করে সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করলে সাধারণত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই পশু বা মুরগী নিধন করা হয়। এজন্য অবশ্য ওই কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেয় ইউএসডিএ। কিন্তু যেসব পশু বা মুরগী ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক নিয়মে মারা যায়, সেগুলোর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না।
অনেকে আবার পরামর্শ দেন, যুক্তরাষ্ট্রের সব পাখিকে টিকা দেওয়া উচিত। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে সব পাখিকে টিকা দেওয়ার ফলে পোলট্রি রপ্তানির ক্ষতি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর প্রায় ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোলট্রি মাংস রপ্তানি করে।
ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান অবস্থান
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে প্রথম দিনেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে দুধ, ডিম ও মাংসের মূল্য কমানো হবে, এমন প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি।
এনিয়ে সম্প্রতি সাংবাদিকের মুখোমুখি হন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। তিনিও হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারির মতো বাইডেন প্রশাসনের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় মেটান।
ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি তেল উত্তোলন বাড়িয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে চান। যদিও অর্থনীতিবিদেরা ট্রাম্পের এই চিন্তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন না। তারা মনে করেন, সরবরাহ ব্যবস্থার অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতি কমানো, বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া ও সর্বোপরি নতুন উৎপাদন নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে ডিমের দাম কমানো যেতে পারে।
আর এনিয়ে ডেমোক্র্যাট শিবিরও ট্রাম্পের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।