যেমন ছিল সেকালের ঈদ

সেকালের ঈদ উদযাপন। ছবি: সংগৃহিত।
সেকালের ঈদ উদযাপন। ছবি: সংগৃহিত।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে আমাদের দৈনন্দিন রুটিন, বদলে গেছে ঐতিহ্য কিংবা অনুশাসন। মাঝে মাঝে হয়তো স্মৃতির কোণায় জমে থাকা শৈশবের উৎসব আমাদের নাড়িয়ে দেয়। দাদা-দাদির মুখে শোনা গল্পগুলো সময়ের স্রোতে এখন কেবলই অতীত। কেমন ছিল আমাদের শৈশবের ঈদ, কেমন ছিল বাবাদের, কিংবা তার বাবাদের, কিংবা তারও বাবাদের?

রাজনীতিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের আত্মকথায় সেকালের ঈদ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। লেখকের জন্ম যেহেতু ১৮৯৮ সালে, তা থেকে ধারণা পাওয়া যায় তিনি ব্রিটিশ শাসনের সময়টির কথাই বলছেন।

তিনি লিখেছেন: “ঈদের জামায়াতেও লোকেরা কাছাধুতি পরিয়াই যাইত। নমাজের সময় কাছা খুলিতেই হইত। সে-কাজটাও নমাজে দাঁড়াইবার আগে তবু করিত না। প্রথম প্রথম নমাজের কাতারে বসিবার পর অন্যের অগোচরে চুপি চুপি কাছা খুলিয়া নমাজ শেষ করিয়া কাতার হইতে উঠিবার আগেই কাছা দিয়া ফেলিত।”

এযুগে ঈদ নিয়ে মুসলিম সমাজের মধ্যে যতোটা আগ্রহ সেযুগে কিন্তু তেমনটা ছিল না। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলার দরিদ্র কৃষি পরিবারে ঈদ উৎসবের কোনো ধুমধাম থাকতো না। এমন না যে তারা ধর্মকর্ম নিয়ে উদাসীন ছিলেন, বরং কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে বিত্তহীনতা ও নগদ পয়সার অভাব ধর্মীয় উৎসব পালনে তাদেরকে পিছিয়ে রেখেছিল।

ব্রিটিশ আমলের কোনো এক ঈদের দিনে আহসান মঞ্জিলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। ছবি: সংগৃহিত।

ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলের শেষ দিকেও গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের যারা শহরে চাকরি করতেন বা ছোটখাটো ব্যবসা বা ওকালতি করতেন, তাদের বাড়িতে ঈদের দিনের খাদ্যতালিকায় পোলাও-কোরমা-জর্দার দেখা মিলত। তাদের সন্তানসন্ততিরাও ভালো কাপড়চোপড় পেত মা-বাবার কাছ থেকে। এসব পরিবারের বড়রাও ঈদে নতুন জামাকাপড় কিনতেন।

কিন্তু বিপুলসংখ্যক দেহাতি মানুষ প্রায় ভুখানাঙ্গা অবস্থায়ই ঈদের দিনটি অতিক্রম করতেন সেকালে। জাকাতের দান-খয়রাত, মসজিদের শিরনি বা সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি থেকে দেওয়া কিছু ভালো খাবারই ছিল তাদের ঈদের দিনের সম্বল।

সেকালে পূর্ববাংলায় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়। কোরবানির কথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে বাঙালি মুসলিম লেখকদের স্মৃতিকথায়।

সুবাহ-ই-বাঙ্গালা বা বঙ্গ প্রদেশে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই আরব বণিকদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যাতায়াত ছিল। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, অলি-আউলিয়া, পির-মুরশিদের মাধ্যমেই এ দেশে ইসলাম প্রচার হতে থাকে। যারা ইসলাম গ্রহণ করেন তারা অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, বিশেষ করে নিম্নবর্ণের হিন্দু। সমাজে তাদের প্রতিপত্তি কমই ছিল। যখন তারা ইসলাম ধর্মের পাঁচ ভিত্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করে ইসলামি উৎসবাদি পালন করতে থাকে তখন যে উৎসবটি নিয়ে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় তা হলো কোরবানির ঈদ।

আবুল মনসুরের লেখার কাছাধুতি পরার শানে নুযুলের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মুসলমানে ধর্মান্তরিত হওয়ার ইতিহাস থেকে।

এই যে ঈদুল আজহাকে বকরি ঈদ বলা হয়, তার পেছনেও রয়েছে ইতিহাস। হিন্দু জমিদার অধ্যুষিত এই অঞ্চলে গরু কোরবানি সম্পর্কে বৈরী মনোভাব থাকার কারণে সেসময় ছাগল তথা বকরি কোরবানি দিতে হতো। ঊনিশ শতকের সাহিত্য ও সংবাদ-সাময়িকপত্রে তার প্রমাণ মেলে।

১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী গো-রক্ষা আন্দোলনের সূচনা করেন। প্রচারপত্রের মাধ্যমে হিন্দু জনসাধারণকে হাটে-বাজারে মুসলমান কসাই-এর কাছে গরু বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে কোরবানিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে অবস্থান করে এবং এর পক্ষে ও বিপক্ষে কবিতাও রচিত হয়।

সেসব প্রেক্ষাপটেই মীর মোশাররফ হোসেন লিখেছিলেন ‘গোজীবন’। এতে মুসলমান সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ক্ষোভটা কতখানি তীব্র ছিল তা উপলব্ধি করা যায় পণ্ডিত রেয়াজ উদ্দীন আহমদ মাশহাদীর লেখা ‘অগ্নি কুক্কুট’ গ্রন্থ পাঠে। এ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

পাকিস্তান আমলেও ঈদের দিন ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন নারীরা। তবে সে সময় তাঁদের বাহন ছিল পর্দাঘেরা রিকশা। ছবি: সংগৃহীত।

জাহানারা ইমাম ‘অন্য জীবন’ গ্রন্থে কোরবানির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন: “কোরবানির সময় আমাদের বাড়িতে চালের আটার রুটি বানানো হতো। সে একটা দেখবার মতো জিনিস। রসুনের খোসার মতো পাতলা রুটি, ধবধবে সাদা এবং সুগোল। …বকরিদের সকালে কোরবানি না হওয়া পর্যন্ত কেউ কিছু মুখে দিতেন না। পুরুষেরা গোসল সেরে নতুন কাপড় পরে নামাজ পড়তে যেতেন খালি পেটেই। ফিরে এসে একেবারে  কোরবানি দিয়ে তারপর বাড়িতে ঢুকতেন। ততক্ষণে মেয়েদের রুটি, হালুয়া, সেমাই, ফিরনি সব রান্না শেষ।’ জাহানারা ইমাম বর্ণিত স্মৃতিকথায় ঈদের দিনের বাঙালি সংস্কৃতি, লোকজ ঐতিহ্য যা এ  দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে কয়েক শ বছর ধরে মিশে আছে।”

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও মানুষের হাতে তেমন একটা টাকা পয়সা থাকত না। সত্যি বলতে, একটা বড় অংশ ছিল কৃষিজীবী। বাড়ির ফসল বিক্রির টাকাই ছিল তাদের আমোদ-প্রমোদের অর্থের উৎস।

তখন সংসারের স্বাভাবিক বাজারঘাট, চিকিৎসা, লেখাপড়া সবকিছু চলত চাল বিক্রির টাকায়। আয়ের প্রধান উৎস ধানের ফলনও বেশি ছিল না। সুতরাং নেহাত জরুরি না হলে চাল বিক্রি অনুমোদন জুটত না সংসারে।

সেসময় মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে ঈদুল আজাহায় সকালের মেনুতে থাকতো সেমাই, পায়েস আর বিকেলে কোরবানির গোশত। এখন যেমন সপ্তাহখানেক কোরবানির গোশত বাসা থেকে শেষ হয়ই না। তখন কিন্তু ওই গোশত দুই ওয়াক্তের বেশি চলত না। গোশত সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তখনকার সময়ে কোরবানির পশু নিয়ে এমন প্রতিযোগিতা চোখে পড়ত না।

ইতিহাসবিদ শামসুজ্জামান খানের লেখায় দেখা মেলে বাংলাদেশের ধর্মীয় উৎসবের রূপান্তর। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর নগর উন্নয়ন, মধ্যবিত্তের বিপুল বিস্তার এবং নগদ অর্থবিত্তের সমাগমে ঈদ উৎসব এক প্রধান বর্ণাঢ্য ও জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।

আর এভাবেই কালে কালে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদ অনুজ্জ্বল থেকে ক্রমে ক্রমে অত্যুজ্জ্বল মহিমায় অভিষিক্ত।

আরও পড়ুন