আবারও একপাক্ষিক নির্বাচন? শিরোনাম বিবিসির

২০২৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের পরের দৃশ্য। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
২০২৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের পরের দৃশ্য। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বাংলাদেশে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনাও তত বাড়ছে। তার মধ্যেই বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এক পাক্ষিক নির্বাচনের আভাস নিয়ে।

রোববার প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে শিরোনাম দেয়া হয়েছে- ‘আবারও কী একপক্ষীয় নির্বাচনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে?’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই কথাটি বহুল উচ্চারিত; তা হচ্ছে, ভোটে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দেয় এক পক্ষ, আর আওয়ামী লীগের বিরোধীরা ভোট দেয় আরেক পক্ষে।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে- “যদিও গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এখন পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ছোট ছোট অনেক দলই এখন এই দুই বলয়ে বিভক্ত। তারপরেও ভোটের রাজনীতিতে এদের সবারই দীর্ঘকালীন পরিচিত হলো ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী’ হিসেবেই।”

জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে আওয়ামী লীগ এখন ছন্নছাড়া অবস্থায়। দলের নেতারা কেউ কারাগারে, কেউ দেশের বাইরে। দলটির কা কার্যক্রমে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তার ওপর নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন স্থগিত করায় ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে দলটির অংশ নেওয়ার পথও বন্ধ।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, তার সবগুলোই ছিল একতরফা। দুটি নির্বাচনে অধিকাংশ দল অংশই নেয়নি। একটিতে অংশ নিলেও কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেছিল।

এখন সেই দলগুলোর কেউ বলছে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না। কোনো কোনো দল বলছে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের আগে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।

তা যদি হয়, তাতে শুধু আওয়ামী লীগ বিরোধীদেরই ভোটে দেখা যাবে, তা এখন স্পষ্ট। একজন নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি সিলেটে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আইনগতভাবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত। স্থগিত দল মানে তাদের সকল কার্যক্রম স্থগিত। তাই আগামী নির্বাচনে তারা অংশ গ্রহণ করতে পারবে না।”

মামলায় পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না- এমন বিধান রেখে সম্প্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতার প্রার্থী হওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

শুরুতে আওয়ামী লীগের কথা বললেও এখন জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকেও নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাইছে অভ্যুত্থানকারী তরুণদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

বিবিসি বাংলা এমন শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রোববার। ছবি: বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট।

দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন শুক্রবার ঢাকায় দলীয় এক সভায় বলেছেন, “আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টিকেও অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যাবে না।”

সাবেক ডাকসু ভিপি নূরুল হক নুরের গণ অধিকার পরিষদও গত কয়েক মাস ধরেই জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের বিরুদ্ধে সোচ্চার। একই মনোভাব পোষণ করছে জামায়াতে ইসলামীও।

তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপি অনেকটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। দলটি আগে থেকেই নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিরোধিতা করছে। দলটি বলছে, কোনো দলের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো অভিযোগ থাকলে সেটি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হোক।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত না হলে বা আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ না হলে যে কোনো ব্যক্তির নির্বাচনের অধিকার আছে। যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার হতে হবে। কিন্তু বাকি সবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ থাকা উচিৎ।

“একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চাইলে সবাইকেই অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। আমার মনে হয় ঢালাওভাবে বিভিন্ন দলকে নিষিদ্ধ করার দাবির মধ্যে বিএনপিকে ফাঁদে ফেলার একটি কৌশল কাজ করছে।”

তার মতে, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ১৪ দল বা তাদের সমমনা দলগুলোকে বাদ দেয়ার পর অন্য দলগুলো যদি বিভিন্ন দাবি সামনে এনে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায়, তখন বিএনপির কিছুই করার থাকবে না।

আওয়ামী লীগ ভোটে না থাকলেও তাদের যে বিপুল সংখ্যক ভোটার রয়েছে, তা সবাই স্বীকার করেন। সেই ভোটাররা কী করবেন, সেটাও দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৯১ সালের আগে ও ২০০৮ সালের পরের সব নির্বাচন একপক্ষীয় হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আওয়ামী লীগ নিজেই বহুদলীয় নির্বাচনের সুযোগ ধ্বংস করেছে। জুলাই আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্রাত্য হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে যুদ্ধের মতো প্রতিযোগিতা। এখন আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকে বাইরে রাখার কথা বলা হচ্ছে। আবার তারা (আওয়ামী লীগ) কামব্যাক করলেও তেমনটাই হবে।”

দেশের পাশাপাশি বিদেশেও বিষয়টি যে আলোচনায় রয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার চিঠিতে।

সেই চিঠিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রকৃত বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফেরার পথ বাধাগ্রস্ত করবে এবং বাংলাদেশি ভোটারদের বড় অংশকে কার্যত বঞ্চিত করবে।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনও এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারলে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হলো কি-না সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে কি-না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “সে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, স্বাভাবিক।”

নির্বাচনকে ভোটারদের জন্য অংশগ্রহণমূলক করতে চান- একথা বলার সিইসিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- আওয়ামী লীগের যে সমর্থক গোষ্ঠী তারা সবাই ভোট দেবে?

জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমি তো আশা করি তারা আসবে। এদের সমর্থকগোষ্ঠী আছে তো। তারা যে একেবারেই আসবে না এটা আমরা মনে করি না।”

কিন্তু কার্যক্রম নিষিদ্ধ অবস্থায় দলটির নেতা বা সমর্থকরা নির্বাচন বা ভোটে আদৌ অংশ নেবে কিনা, তা পরিষ্কার নয়, প্রতিবেদনটি এভাবেই শেষ করেছে বিবিসি বাংলা।

আরও পড়ুন